বৃহস্পতিবার চার শতাধিক সৌদি প্রবাসী দেশটিতে ফিরতে পারেননি

ঢাকা থেকে সৌদি আরবের দাম্মাম, রিয়াদ ও জেদ্দা রুটে চলাচল করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এছাড়াও প্রায় আটটি রুটে চলে সৌদি এয়ারলাইন্স (সাউদিয়া)। এসব রুটের একমুখী প্লেন (ওয়ান ওয়ে) ভাড়া সর্বনিম্ন ৪৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫৭ হাজার টাকা। রুটগুলোর যাত্রীদের টিকিটের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে সাত দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের খরচ। সৌদি সরকার নির্ধারিত হোটেলে এই কোয়ারেন্টাইনের খরচ ৬৫ হাজার ৭০০ টাকা, যা টিকিটের মূল্যের চেয়েও প্রায় ২০ ভাগ বেশি। যদিও বৃহস্পতিবার (২০ মে) থেকে বাংলাদেশি প্রবেশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সৌদি সরকার। 

সৌদি সরকারের নেওয়া এমন সিদ্ধান্ত অমানবিক বলে মনে করেন সৌদি প্রবাসীরা। বৃহস্পতিবার চার শতাধিক সৌদি প্রবাসী শ্রমিক টাকা না থাকায় এবং নিয়মমাফিক হোটেল বুকিং না করায় দেশটিতে ফিরতে পারেননি।

প্রবাসীরা বলছেন, একদিকে কোয়ারেন্টাইনের দ্বিগুণ খরচ, আরেকদিকে তথ্য বিভ্রাট সবমিলিয়ে আমরা নিঃস্ব হতে চলেছি।

মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন নামে একজন দাম্মাম প্রবাসী বলেন, আগামী ২৩ মে আমার সাউদিয়ায় ফ্লাইট। কিন্তু আমি এখনও হোটেল বুকিং দিতে পারিনি। যেই ট্রাভেল এজেন্সি থেকে ফ্লাইট বুকিং করেছিলাম, তারা হোটেল বুক করতে পারবে না। কত টাকা লাগে কোথায় গিয়ে বুক করব কিছুই জানি না। বৃহস্পতিবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাওয়ার পর সেখান থেকে সাউদিয়ার সোনারগাঁও হোটেলের কার্যালয়ে পাঠানো হয়। তবে তারা ২১-২২ মে’র টিকিটধারীদের হোটেল বুকিং করায়, কিন্তু আমারটা করায়নি।

তিনি বলেন, ঢাকায় এসে জানতে পারলাম কোয়ারেন্টাইন খরচ ন্যূনতম ৬৬ হাজার টাকার মতো (সর্বনিম্ন ২৯০০ সৌদি রিয়াল বা বাংলাদেশি ৬৫ হাজার ৭০০)। এখন একদিনের মধ্যে এত টাকা কীভাবে জোগাড় করব, সেটা বুঝতে পারছি না।

এদিকে হোটেল বুকিং দিয়ে নতুন করে বিপাকে পড়েছেন সৌদি প্রবাসীরা। নাজিম খান নামে এক প্রবাসী বলেন, আমি রিয়াদে থাকি। পরিচিত একজনের পরামর্শে বুকিং ডটকম থেকে সাত দিনের জন্য ২৫ হাজার টাকা দিয়ে হোটেল বুকিং করেছিলাম। তবে সাউদিয়া জানাল, এই বুকিংয়ে কাজ হবে না। সৌদি সরকার কোয়ারেন্টাইনের জন্য হোটেল বুকিং করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে আমার অতিরিক্ত ৮০ হাজার টাকা খরচ হলো।

এদিকে দুদিন সৌদির ফ্লাইটে চড়তে পারেননি অনেক যাত্রী। সৌদি এয়ারলাইন্স জানায়, অনেকেই হোটেল বুকিং করেছেন। তবে তারা সৌদি আরবের অবস্থানকালীন মোবাইল নম্বর না দিয়ে বাংলাদেশের ফোন নম্বর দিয়েছেন। এতে বুকিং বাতিল হয়েছে। অনেকে আবার সৌদি সরকারের নির্ধারিত হোটেলে বুকিং না দিয়ে ইচ্ছা মতো বুকিং করেছে। কেউ কেউ সৌদিতে তার পরিচিতদের ফোন করে হোটেল বুকিং করিয়েছে। এমন হলে তাদের সৌদি বিমানবন্দর থেকেই ফেরত দেওয়া হবে। তাই তাদের সোনারগাঁও হোটেলের কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সৌদি এয়ারলাইন্সের কাস্টমার রিপ্রেজেন্টেটিভ মো. নাসিম আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেকেই ত্রুটিপূর্ণভাবে হোটেল বুকিং করাচ্ছে। এমন হলে আমরা তাদের ফ্লাইটে নিতে পারব না। ফ্লাইটে নিলেও লাভ হবে না, তাদের বিমানবন্দর থেকেই বাংলাদেশে ফেরত দেওয়া হবে। তাই সুস্পষ্টভাবে বুকিংয়ের জন্য তাদের সোনারগাঁও কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে।

প্রবাসীদের খরচ এখানেই শেষ নয়। সৌদি সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, একজন প্রবাসীকে সৌদি পৌঁছে নিজ খরচে একবার করোনা টেস্ট করতে হবে। কোয়ারেন্টাইনের ষষ্ঠ দিন আবার টেস্ট করাতে হবে। প্রতিবার ১২৯ সৌদি রিয়াল করে বাংলাদেশিদের দুই টেস্টে খরচ হবে প্রায় ৬ হাজার টাকা।

ঝামেলা এড়াতে ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে বিমান

এদিকে সৌদি সরকারের কোয়ারেন্টাইনসহ নানা বিধিনিষেধে ঝামেলা এড়াতে পাঁচ দিনের জন্য সৌদি রুটে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রেখেছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিমানের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম-জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সৌদি কর্তৃপক্ষের হোটেল কোয়ারেন্টাইনসহ বিভিন্ন শর্তারোপের কারণে পাঁচ দিনের জন্য সৌদিআরবগামী সব ফ্লাইট পরিচালনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বিমান বাংলাদেশ।’

বিমান সূত্রে জানা গেছে, জটিলতা নিরসন না হলে বিমানের ফ্লাইট স্থগিতের মেয়াদ আরও বাড়তে পারে।

সৌদি সরকারের বিধিনিষেধ

সম্প্রতি এক আদেশে ২০ মে (বৃহস্পতিবার) থেকে বাংলাদেশ থেকে সৌদিগামী প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য সৌদি আরবে প্রবেশের ক্ষেত্রে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করে দেশটির সরকার।

বিধিনিষেধের মধ্যে রয়েছে- যারা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেননি, তাদের সৌদি আরবে প্রবেশ করলে সাত দিন হোটেলে বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে হোটেল খরচ নিজেকেই বহন করতে হবে।

সৌদি আরবে যাওয়ার আগের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসলেই কেবল ঢাকা থেকে যাত্রীরা ফ্লাইটে উঠতে পারবেন। সৌদিতে পৌঁছানোর পর আরও দুই বার করোনা টেস্ট করতে হবে। প্রথমবার টেস্ট করতে হবে সৌদি আরবে পৌঁছানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। এরপর কোয়ারেন্টাইনের ষষ্ঠ দিনে আবারও করোনা টেস্ট করা হবে। করোনা টেস্ট করার খরচ যাত্রীকেই বহন করতে হবে। দুই বার টেস্টে নেগেটিভ রিপোর্ট এলে হোটেল কোয়ারেন্টাইন থেকে ৭ম দিনে নিজ বাসায় যাওয়া যাবে।

এছাড়া যারা পূর্ণ ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছে, তাদের ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রমাণপত্র সঙ্গে রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে ফাইজার-বায়োএনটেকের দুই ডোজ, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ, মডার্নার দুই ডোজ এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার এক ডোজ যারা নিয়েছে, তারা হোটেলে বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকার বদলে বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকার সুবিধা পাবেন।

প্রথমবারের মতো সৌদিপ্রবাসীকে সৌদি আরবে যাওয়ার আগে হেলথ ইন্স্যুরেন্স করতে হবে। করোনা হলে ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠান তার চিকিৎসা ব্যয় বহন করবে- বিষয়টি ইন্স্যুরেন্সে স্পষ্ট থাকতে হবে।

আদেশে বলা হয়, ভ্রমণ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দিলে শাস্তি হিসেবে নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

অন্যদিকে সিভিল এভিয়েশনের দেওয়া চিঠিতে করোনা নিয়ে সরকারি পাবলিক প্রসিকিউসন বিভাগের জারি করা একটি আদেশ হুবহু তুলে ধরা হয়। আদেশটিতে বলা হয়েছে, কেউ যদি করোনাভাইরাস ছড়ায় তাকে পাঁচ বছরের জেল এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ সৌদি রিয়াল জরিমানা করা হবে। যদি সেই ব্যক্তি প্রবাসী হয়, তবে তাকে শাস্তি দেওয়া পর সৌদি আরব থেকে বিতাড়িত করা হবে এবং সে আর কোনো দিন সৌদি আরবে আসতে পারবে না।

এআর/এসএসএইচ