স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের আগে ভিয়েনা কনভেনশন অন দ্য ল অব ট্রিটিস (ভিসিএলটি) এ পক্ষভুক্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আইনটিতে পক্ষভুক্ত হলে আন্তর্জাতিক চুক্তি সংক্রান্ত কোনো ব্যাখ্যা বা বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ কনভেনশনটির বিধান প্রয়োগ করতে পারবে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের চুক্তি, ব্যাখ্যা, কার্যকারণ, সংশোধন ও নিয়ন্ত্রণে কোনো একক কাঠামো অনুসরণ করা হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তির খসড়া প্রণয়ন, চুক্তিতে স্বাক্ষর, চুক্তির সংশোধন কিংবা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আগে থেকেই ভিসিএলটি অনুসরণ করছে। কেননা চুক্তি বা স্মারক নিয়ে মতের ভিন্নতা থাকলে কিংবা বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কনভেনশনটির বিধান ব্যবহার সর্বজন গ্রহণযোগ্য।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে— পাকিস্তান, নেপাল ও মালদ্বীপ এই আইনের পক্ষভুক্ত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১১৬টি দেশ এই কনভেনশনে পক্ষভুক্ত। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জা‌নিয়েছেন, এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের আগেই ভিসিএলটিতে বাংলাদেশের পক্ষভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এ নিয়ে চলতি বছরের শুরুতে প্রাথমিক কাজ ও গবেষণা করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর আলোকে সরকারের পক্ষে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করে এমন ২৯টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ চিহ্নিত করা হয়। তাদের কাছে গবেষণা প্রতিবেদনের অনুলিপি পাঠিয়ে ভিসিএলটিতে বাংলাদেশের পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়ে মতামত জানতে চায় মন্ত্রণালয়। এতে ৭টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ এ বিষয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে। এছাড়া, গত অক্টোবরে এই ইস্যুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সামনে আরও একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

আইনটিতে পক্ষভুক্ত হওয়া নিয়ে মতামত দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয় 

ভিয়েনা কনভেনশন অন দ্য ল অব ট্রিটিস-এ পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশের দেশীয় আইনের সঙ্গে কনভেনশনটির কোনো অনুচ্ছেদের বিরোধ থাকলে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেসব অনুচ্ছেদের বিষয়ে রিজারর্ভেশন প্রদান করতে পারে। এ জন্য কনভেনশনটির ২৫, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৪০, ৪১, ৪৬, ৬৬ ৭৩, ৮২, ও ৮৩ এর ধারাগুলো দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে, কনভেনশনটির অনুচ্ছেদ-৬৬ (সেটেলমেন্ট অব ডিসপুটস) বিস্তারিত পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতামতের প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন ও দেশীয় আইনের মধ্যে কখনো বিরোধ দেখা দিলে সে ক্ষেত্রে সর্বজনস্বীকৃত আন্তর্জাতিক আইনের বিধান প্রাধান্য লাভ করে। আন্তর্জাতিক কনভেনশনের লক্ষ্য, একটি নিয়মতান্ত্রিক বিশ্বকাঠামো প্রতিষ্ঠা। 

আইনটি নিয়ে জানতে চায়— সুরক্ষা সেবা, তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ ও ত্রাণ-দুর্যোগ মন্ত্রণালয়

আইনটিতে পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়ে সুরক্ষা সেবা বিভাগ জানিয়েছে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পাদিত ভিসা অব্যাহতি চুক্তির বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইনের শরণাপন্ন হওয়ার সুযোগ রাখা হয়। সে ক্ষেত্রে ভিসিএলটি প্রযোজ্য হওয়ার সুযোগ আছে কি না। 

সুরক্ষা সেবা বিভাগের এমন মতামতের প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কোনো চুক্তি সম্পাদনের সময় চুক্তির ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বিরোধগুলো কীভাবে নিষ্পত্তি হবে তার সুস্পষ্ট পথ উল্লেখ করা থাকে। সে অনুযায়ী সেই বিরোধ নিষ্পন্ন করা হয়। দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে স্থায়ী সালিশ আদালত কিংবা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে শরণাপন্ন হওয়াকে সর্বশেষ উপায় হিসেবে মনে করা হয়। প্রাথমিকভাবে বিরোধ-নিষ্পত্তির দিকে না গেলেও, সম্পাদিত চুক্তিসমূহের ব্যাখ্যার প্রয়োজনেও বাংলাদেশের জন্য কনভেনশনটির পক্ষভুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা, সর্বজনগ্রাহ্য কনভেনশনটির পক্ষভুক্ত না হলে সম্পাদিত চুক্তির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ তার নিজ ধ্যানধারণা প্রয়োগ করবে, যা দুটি দেশের মধ্যে এক না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

ভিসিএলটি কেবল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিসমুহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বা কোনো বেসরকারি অংশীদারের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে এই কনভেনশনটি প্রযোজ্য হবে না

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ জানতে চায়, ১৯৬৯ সালের কনভেনশনটিতে বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো পক্ষভুক্ত হয়েছে কি না। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানতে চায়, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার যদি কনভেনশনটিতে পক্ষভুক্ত না হয়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পক্ষভুক্ত হওয়ার ফলে কোনো সুবিধা পাবে কি না। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে নেপাল (১৯৬৯), পাকিস্তান (১৯৭০ সালে) কনভেনশনটিতে স্বাক্ষর করেছে। মালয়েশিয়া (১৯৯৪), মিয়ানমার (১৯৯৮), ভিয়েতনাম (২০০১), চীন (২০০১), মালদ্বীপ (২০০৫) ও স্বাধীনতার এক দশকের মধ্যে পূর্ব তিমুর (২০১৩ সালে) কনভেনশনে পক্ষভুক্ত হয়। এ পর্যন্ত ১১৬টি দেশের ভিসিএলটির পক্ষভুক্ত হওয়ায় এই চুক্তিটির সার্বজনীনতা ও যৌক্তিকতা প্রমাণিত। 

বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিনিয়ত বিস্তৃত হচ্ছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য বর্তমানে প্রয়োজন প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য অপেক্ষা না করে স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজ আইনি কাঠামো সুসংহতকরণ এবং ভিসিএলটি এর মতো মৌলিক কনভেনশনগুলোর পক্ষভুক্ত হওয়া। 

কনভেনশনটি কেবল এর পক্ষভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার্য; তবে ভিসিএলটি একটি সর্বজনগ্রাহ্য আন্তর্জাতিক কনভেনশন হওয়ায়, এর পক্ষভুক্ত না হয়েও অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও অতীতে নিজ আইনি অবস্থানের ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য কনভেনশনটি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করেছে। 

কনভেনশনটির পক্ষভুক্ত হলে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান আরো দৃঢ়তা লাভ করবে এবং সম্পাদিত আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ সংক্রান্ত কোনো ব্যাখ্যা বা বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কনভেনশনটির বিধান প্রয়োগ করতে পারবে। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম রাষ্ট্র হিসেবে মানবাধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মৌলিক ৯টি কনভেনশন এর সবগুলোর পক্ষভুক্ত হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।

মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় নেতিবাচক ভূমিকা পড়বে কি না জানতে চায় ক্রীড়া মন্ত্রণালয়

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় জানতে চায়, কনভেনশনটিতে পক্ষভুক্ত হওয়ার কারণে মেধাস্বত্ব সুরক্ষা সংক্রান্ত যে সুবিধা বাংলাদেশ পেয়ে আসছে, সেসব ক্ষেত্রে কোনো নেতিবাচক ভূমিকা পড়বে কি না। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, অন্যান্য দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা ও নেগোসিয়েশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রায়ই মেধাস্বত্ব, পরিবেশ সুরক্ষা ও সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়া প্রসঙ্গের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এসব চুক্তি স্বাক্ষর করতে হলে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক মানদণ্ডে উন্নীত হতে হবে। মেধাস্বত্ব নিয়ে বাংলাদেশ যে সুবিধা পেয়ে আসছে, ২০২৬ সালের পর স্বল্পোন্নত দেশসমূহের তালিকা থেকে বাংলাদেশ উন্নীত হলে এসব সুবিধা আর পাওয়া যাবে না। 

বাংলাদেশের জন্য একটি ভবিষ্যতমুখী কৌশলী কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন। যাতে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা ও নেগোসিয়েশন এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরো উদ্যমী ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কনভেনশনটিতে পক্ষভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে বলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করছে। 

এছাড়া সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ভিসিএলটি কেবল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিসমুহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বা কোনো বেসরকারি অংশীদারের সঙ্গে চুক্তির ক্ষেত্রে এই কনভেনশনটি প্রযোজ্য হবে না।

কনভেনশনটির অনুসমর্থন এর পদ্ধতি সংক্রান্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক প্রশ্নে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কনভেনশনটি বর্তমানে স্বাক্ষর ও অনুসমর্থনের জন্য উন্মুক্ত নেই। এর ফলে কনভেনশনটির ৮৩ নম্বর অনুচ্ছেদ এর বিধান অনুসরণ করে বাংলাদেশকে পক্ষভুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, দ্বিপাক্ষিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিসমূহে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বাংলাদেশের আইনি কাঠামো দৃঢ়তর ও সর্বজনগ্রাহ্য করা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চুক্তি ও মেধাস্বত্ব বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদসমূহে বাংলাদেশের পক্ষভুক্তি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

ভিসিএলটি আইন রাষ্ট্র সমূহের মাঝে সম্পাদিত চুক্তি সম্পাদনের ব্যাকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা বাংলাদেশের দেশীয় আইন ১৮৯৭ সালের জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট এর আন্তর্জাতিক ভার্সন।

এনআই/এমএসএ