আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসন থেকে দুইবার সংসদ সদস্য (এমপি) হয়েছিলেন আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দিন নদভী। জামায়াতের তকমা গায়ে থাকলেও নিজ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদেরই সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছেন বলে অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে একের পর এক জামায়াত নেতাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কব্জায় নেন তিনি।

চট্টগ্রামে জামায়াত নেতাদের হাতে প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (আইআইইউসি)। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও দলটির নেতারা প্রতিষ্ঠানটির দিকে নজর দেননি। তবে ২০২১ সালে এসে প্রতিষ্ঠানটির ওপর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে নদভীর। বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তার সহায়তায় ওই বছরের মার্চে প্রতিষ্ঠানটি কব্জায় নেন তিনি।

শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের পক্ষ থেকে আইনিভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়। নদভী দখলে নেওয়ার পর উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আ ন ম শামসুল ইসলাম। তখন আইনিভাবে একটু বেকায়দায় পড়েন নদভী। এরপর তিনি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দায়িত্বে থাকা লোকজনের ওপর চড়াও হন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কয়েকজন সদস্যকে আসামি করে মামলা করেন।

নদভীর হয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্যদের হয়রানির পুরস্কার হিসেবে এলাকার মসজিদের জন্য ৩০ লাখ টাকা অনুদান চান সিরাজুল হক। ২০২২ সালের ৫ নভেম্বর সহায়তা চেয়ে আবেদন করা হয় নদভীর পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনে। লিখিত আবেদনের সঙ্গে সিরাজুল হকের একটি ভিজিটিং কার্ড সংযুক্ত করা হয়

 একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা দেন। দুদক কর্মকর্তাদের দিয়ে চাপ দেওয়া হয় তৎকালীন শামসুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দায়িত্বে থাকা জামায়াত নেতাদের।

এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন দুদকের উপ-পরিচালক (ডিডি) মোহাম্মদ সিরাজুল হক। ওই কর্মকর্তা এখন সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত রয়েছেন। গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া হওয়ায় আগে থেকে নদভীর সঙ্গে সখ্য ছিল তার।

দুদক সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের দায়িত্বে থাকা জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে দুদকে জমা পড়া অভিযোগ গ্রহণ থেকে শুরু করে অনুসন্ধান পর্যন্ত পুরো কার্যক্রমের তদারকিতে ছিলেন সিরাজুল হক। তার তদারকিতেই এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। পরে অনুসন্ধান করে সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা প্রতিবেদনও জমা দেন। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মামলা হওয়ার কথা ছিল। যদিও এরই মধ্যে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে মামলা আর হয়নি।

নদভীর হয়ে বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্যদের হয়রানির পুরস্কার হিসেবে এলাকার মসজিদের জন্য ৩০ লাখ টাকা অনুদান চান সিরাজুল হক। ২০২২ সালের ৫ নভেম্বর সহায়তা চেয়ে আবেদন করা হয় নদভীর পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনে। লিখিত আবেদনের সঙ্গে সিরাজুল হকের একটি ভিজিটিং কার্ড সংযুক্ত করা হয়।

সিরাজুল হকের এলাকার মসজিদের জন্য অনুদান হিসেবে নেওয়া ১০ লাখ টাকার মেমো ও আবেদন কপি

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন বরাবরে করা আবেদনটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব শাখায় পাঠিয়ে দেন নদভী। সেখান থেকে সিরাজুল হকের চাওয়া বিবেচনায় নিয়ে মসজিদের জন্য ১০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা একেএম আসাদুজ্জামান সোনালী ব্যাংকে গিয়ে ওই মসজিদের অ্যাকাউন্টে ১০ লাখ টাকা জমা দেন।

একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সিরাজুল হকের মসজিদের জন্য অনুদান নেওয়ার পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য দেখছেন অনেকে।

আইআইইউসির বর্তমান ভাইস-চেয়ারম্যান ও জামায়াতের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ শাহজাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদভী চর দখলের মতো করে আইআইইউসি দখল করেছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে তার নির্দেশে যত কাজ হয়েছে সবই অবৈধ। দুদক কর্মকর্তা অনুদানের জন্য আবেদন করেছেন ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনে কিন্তু টাকা দেওয়া হয়েছে আইআইইউসির ফান্ড থেকে। এভাবে নদভী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেভাবে পেরেছেন লুটপাট করেছেন।

দুদক কর্মকর্তার মসজিদে অনুদান দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে জানতে আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক রয়েছেন।

তবে নদভীর আমলে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করা আখতারুজ্জামান কায়সার ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদক কর্মকর্তার মসজিদে কোন প্রক্রিয়ায় টাকা দেওয়া হয়েছে তা আমার জানা নেই।

দুদকের একটি সূত্র জানায়, দুদক কর্মকর্তা সিরাজুল হকের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়ায়। তিনি আলোচিত কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্প নিয়ে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তার আগে একই অভিযোগের অনুসন্ধান দুদকের আরেকজন কর্মকর্তাও করেছিলেন। তিনি প্রকল্পটি ঘিরে দুর্নীতির পর্যাপ্ত প্রমাণ পেয়ে কক্সবাজার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে সিরাজুল হক দায়িত্ব নিয়ে মামলায় আর হতে দেননি। ফলে অব্যাহতি পেয়ে যান সাবেক মেয়র মুজিব।

জানতে চাইলে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সিরাজুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যক্তি হিসেবে আমি আবেদন করে এলাকার মসজিদের জন্য নদভী থেকে অনুদান নিয়েছি। দুদক থেকে নদভীকে আমি কোনো সহায়তা করিনি। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও আমার কোনো ভূমিকা নেই।

কক্সবাজার পৌরসভার মেয়রকে অব্যাহতি দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ওইটা নিয়ে মামলা হয়নি। একটা অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান হয়েছে। অভিযোগটি আমার আগে আরেকজন তদন্ত করেছিল। আমি খুব বেশি তদন্ত করার সুযোগ পাইনি। বদলির সুবাদে অন্যত্র চলে গিয়েছিলাম।

জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগটি তদন্ত করেছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক ফয়সাল কাদের। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি অভিযোগটির অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি।

বর্তমানে দুদকের চেয়ারম্যান পদ খালি। সংস্থাটির সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন খোরশেদা ইয়াসমীন। ঘটনার বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল করা হলেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

দুদকের জনসংযোগ বিভাগের উপ-পরিচালক আকতারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদক কর্মকর্তা সিরাজুল হকের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে দুদকের কোনো কর্মকর্তার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে অনুদান নেওয়ার সুযোগ নেই।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদক তো বটেই, কোনো সরকারি কর্মকর্তা মসজিদ বা মন্দির কিংবা তার আত্মীয়স্বজনের অসুস্থতার কথা বলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নিতে পারেন না। এটি স্পষ্ট দুর্নীতি। যে দুদক কর্মকর্তা মসজিদের নামে অনুদান নিয়েছেন তার আর এক সেকেন্ডও দায়িত্বে থাকার সুযোগ নেই। তাকে যত দ্রুত সম্ভব অব্যাহতি দিয়ে আইনের আওতায় আনা উচিত।

এমআর/এসএসএইচ