বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপ সন্দ্বীপ। এটি চট্টগ্রামের একটি উপজেলা। ঘূর্ণিঝড় কিংবা সামুদ্রিক অন্য কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে প্রতিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয় দ্বীপটি। প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দ্বীপবাসীকে রক্ষা করতে চারপাশে বেড়িবাঁধ দেয় সরকার। কিন্তু জলোচ্ছ্বাসের ৮-১০ ফুট উঁচু ঢেউয়ের কাছে সেই বাঁধও অসহায় হয়ে পড়ে। ভেসে যায় জনপদের পর জনপদ।

সন্দ্বীপের চারপাশের বেড়িবাঁধকে টেকসই করতে সিমেন্ট ও পাথরের তৈরি ব্লক বসানোর পরিকল্পনা হাতে নেয় সরকার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে নেওয়া হয় ৫৬২ কোটি ২১ লাখ টাকার একাধিক প্রকল্প। এসব কাজের দায়িত্ব পায় চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কাজ পাওয়ার পর থেকে তারা যেন ঘুমিয়ে আছে, কোনো সাড়াশব্দ নেই; প্রকল্পেরও কোনো অগ্রগতি নেই।

বেড়িবাঁধ রক্ষায় ব্লক বসালে কিছুটা স্বস্তি পেতেন দ্বীপের বাসিন্দারা। কিন্তু ঠিকাদারদের কোনো তৎপরতা না দেখে সারাক্ষণ ভয় ও আতঙ্কে থাকেন তারা। বড় কোনো ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে এলে ভেসে যাবে দ্বীপের বেশিরভাগ জনপদ। তাই সমুদ্রের বুকে কোনো ঝড়ের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠেন স্থানীয়রা।

এই অনিশ্চয়তা ও অচলায়তনের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করছেন পাউবোর কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ জানান, তিনি প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিনিয়ত তাগাদা দিচ্ছেন, কিন্তু তারা গা করছে না।

পাউবো সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর একনেকে সন্দ্বীপ ব্লক বেড়িবাঁধ প্রকল্পের জন্য ৫৬২ কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ওই বছরের ১৫ অক্টোবর ওই প্রকল্পের পাঁচটি প্যাকেজে ১৫০ কোটি ৭৪ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে অংশ নিয়ে বিশ্বাস বিল্ডার্স কাজ পায়। পরে ওই প্যাকেজের আরও ১০৯ কোটি ২৬ লাখ টাকার কাজসহ মোট ২৬০ কোটি টাকার কাজ পায় প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি বিশ্বাস বিল্ডার্সের সঙ্গে পাউবোর চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ১৫ ফেব্রুয়ারি কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু চুক্তির আট মাস পেরিয়ে গেলেও প্রতিষ্ঠানটি এখনো কাজে হাতই দেয়নি। এ অবস্থায় যথাসময়ে কাজ বাস্তবায়ন করতে বিশ্বাস বিল্ডার্সকে গত ২০ অক্টোবর নোটিশ পাঠায় পাউবো। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ২০২৭ সালের জুনে।

সন্দ্বীপ ব্লক বেড়িবাঁধ প্রকল্পের চারটি প্যাকেজে মোট ১১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার কাজ পায় ই-ইঞ্জিনিয়ার্স নামে আরেকটি কোম্পানি। এ ছাড়া খুলনা শিপ ইয়ার্ড তিনটি প্যাকেজে ৮৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং এম এম কনস্ট্রাকশন দুটি প্যাকেজে প্রায় ৫৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকার কাজ পায়। এসব প্রতিষ্ঠানও পাউবোর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী যথাসময়ে কাজ শুরু করেনি।

স্থানীয়রা জানান, কাজের সবশেষ অবস্থা দেখতে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার সন্দ্বীপ পরিদর্শন করেন প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ। তিনি বেড়িবাঁধকে টেকসই করার জন্য বাস্তবায়ন হতে যাওয়া প্রকল্পগুলোর পাশাপাশি আরও কী কী করণীয় রয়েছে তা সরেজমিনে দেখে যান।

সন্দ্বীপের বাসিন্দা ফোরকান উদ্দিন রিজভী বলেন, বিশ্বাস বিল্ডার্সসহ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই কাজ শুরু করেনি। আমরা তাদের কোনো কর্মকাণ্ড দেখতে পাচ্ছি না। বিশ্বাস বিল্ডার্স আগেও সন্দ্বীপে কিছু কাজ করেছে, তখনও নানা অনিয়ম করেছে। এবারও কাজ নিয়ে তাদের কোনো খবর নেই।

তিনি বলেন, এখন আমাদের দ্বীপবাসীর দাবি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি কাজ শুরু না করে তবে পাউবোকে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে হবে। পুনরায় টেন্ডার দিয়ে ভালো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দ্রুত কাজ বাস্তবায়ন করতে হবে।

প্রকল্পের সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্স। তারা এখনো কোনো কাজ শুরু করেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বাস বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপক ফিরোজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সন্দ্বীপে আগেও অন্য প্রকল্পের কাজ করেছি। আমাদের মালামালও সেখানে রয়েছে। বেড়িবাঁধে ব্লক বসানোর জন্য প্রাথমিক কিছু কাজ করতে হয়। আমরা সেগুলো করছি। দীর্ঘদিন বর্ষা মৌসুম ছিল, এখন কাজ শুরু হবে।

জানতে চাইলে ই-ইঞ্জিনিয়ার্সের কর্মকর্তা মো. মাসুদ বলেন, আমি এতদিন দেশের বাইরে ছিলাম। তাই আমার কাছে বিষয়টির আপডেট কোনো তথ্য নেই।

পাউবোর চট্টগ্রাম পওর বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) ড. তানজির সাইফ আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা প্রত্যেক কোম্পানির সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করছি। ইতোমধ্যে চার কোম্পানিকে নোটিশ দিয়েছি। একটি প্রতিষ্ঠান একেবারেই কাজ শুরু করেনি। বাকিগুলো মালামাল নিচ্ছে, কাজ শুরুর প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। কেউ কেউ কিছু প্রাথমিক কাজ করেছে। প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে বাস্তবায়নে যা করা দরকার আমরা তাই করব।

এমআর/এসএসএইচ