উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রবিউল হোসেনকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দোসর দাবি করে তাকে অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। সম্প্রতি তারা এই মানববন্ধন করেন।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বসে দেশের জনসাধারণের আমানতের অর্থ লোপাট, পাচারসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ এনে রবিউল হোসেনকে অবিলম্বে প্রত্যাহারসহ তাকে আইনের আওতায় এনে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা।

উত্তরা ব্যাংকের এমডি রবিউল হোসেন টানা ২০১৬ সাল থেকে দীর্ঘ সাড়ে ৮ বছর স্বৈরাচারী করে এই পদ ধরে রেখে নজিরবিহীন দুর্নীতি অর্থপাচারকারী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী, আওয়ামীবিরোধী সিবিএ নেতা কর্মীদের হয়রানিসহ চাকরিচ্যুত করা, করোনার প্রণোদনার টাকা আত্মসাৎ, বাংলাদেশ ব্যাংক হতে জরিমানা করা, ঋণ খেলাপিদের ঋণ দিয়ে নিজের পকেট ভর্তি করাসহ অসংখ্য অভিযোগের পরও অদৃশ্য ক্ষমতার বলে চাকরিতে বহাল আছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

দেশ ছেড়ে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী পরিবারের আস্থাভাজন হিসেবে এত বছর উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন তিনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নানা অপকর্মের সহচর রবিউল হোসেন তৃতীয় মেয়াদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ব্যাংকটির মালিকানাও দিয়েছেন। নথিতে দেখা যায়, উত্তরা ব্যাংক সিকিউরিটিজ ব্রোকারেজ হাউজে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নামে যৌথ বিও অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের শেয়ার হস্তান্তর করেন। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবায়েতের যোগসাজশে শেয়ার ম্যানুপুলেট করে হাসিনা ও শেখ রেহানার নামে ৪০টি উদ্যোক্তা শেয়ার হস্তান্তর করা যার বর্তমান মূল্য ৪৫ লাখ টাকার অধিক বলে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছেন উত্তরা ব্যাংক শ্রমিক কর্মচারী পরিষদ এবং ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। শেয়ার হস্তান্তরের পরেই শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আকাশ্চুম্বি হয়ে ওঠে। ফলে শেখ হাসিনার ব্রাজিল ও স্পেনের সফরসঙ্গী হিসেবে এই রবিউল হাসানকে মনোনীত করা হয়। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে একটা প্রাইভেট ব্যাংকের এমডির সঙ্গে একজন পিএমের কি কারণে ব্যক্তিগত সখ্যতা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরা ব্যাংকের একজন পরিচালককে সুবিধা দিতে টয়োটা করোলা ১.৬ এল গাড়িটি ক্রয় করেন উত্তরা ব্যাংকের এমডি। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত না করেই স্পেশাল বোনাস ও বৈশাখী ভাতা গ্রহণ করেছেন তিনি। এ জন্য তাকে ১২ লাখ ৯০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে অডিট আপত্তির মুখে সেই টাকা ফেরতও দিয়েছেন রবিউল। কিন্তু রাজস্বের বাকি টাকা পরিশোধ করেছেন কি না তার জানার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে উত্তরা ব্যাংকের এমডির মাসিক বেতন ১৭ লাখ টাকার অধিক। এর মধ্যে মূল বেতন, বাসা ভাড়া, বাবুর্চি, গার্ড, সার্ভিস চার্জ, পুনঃভরণ ভাতা, বাসা মেরামত, আসবাবপত্র, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, টেলিফোন বিল, ঈদের ভাতা এবং জিপ গাড়ির খরচ অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এর বাইরেও তিনি ২০১৮, ’১৯, ’২০, ’২১ ও ’২২ সালে করোনাকালীন ভাতা, স্পেশাল বোনাস এবং বৈশাখী বোনাস গ্রহণ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাননি।

এ ছাড়া ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চিকিৎসা বাবদ তিনি ২৪ লাখ ২৯ হাজার ৪৫৩ টাকা ব্যাংক থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী যত টাকা রাজস্ব দেওয়ার কথা তা পরিশোধ করেননি। শুধু তাই নয় তার স্ত্রীর বিদেশে অপারেশনের জন্য ব্যাংক থেকে ৫০ লক্ষ্য টাকা বোর্ডের মাধ্যমে পাস করিয়ে নেন যা নজিরবিহীন। বাসায় কুক, গার্ড, সার্ভিস ইত্যাদির জন্য ব্যাংক থেকে নেওয়া ২ লাখ ৬৩ হাজার ৫৩৮ কোটি এবং লিভ ফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্স বাবদ নেওয়া ১৭ লাখ ৬০ হাজার টাকার বিপরীতে কোনো রাজস্ব দেননি এমডি। অথচ কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য কোনোরকম আর্থিক সুবিধা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

রবিউল হাসানের পদত্যাগ ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বাতিলের দাবিতে ব্যাংকটির কর্মকর্তা- কর্মচারীরা বহুবার সমাবেশ করলেও কোনো ফল হয়নি বরং যারা রবিউলের বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছে তাদের নানানভাবে হয়রানি করে চাকরি থেকে অপসারণ করেছে। রবিউলের বিরুদ্ধে মূলধারার বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় সংবাদ প্রকাশিত হলেও ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

অনুসন্ধানে উত্তরা ব্যাংক শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু মো. আহসানুল হাবীব সাংবাদিকদের জানান, শেখ হাসিনার অর্থযোগানদাতা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদারের প্রতিষ্ঠান নাসা গ্রুপকে কারওয়ান বাজার শাখা হতে ২’শ কোটি টাকা, সালমান এফ রহমানের প্রতিষ্ঠানকে ৪০কোটি টাকা ও সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খানের স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে উত্তরা শাখা থেকে ২১ কোটি টাকা অবৈধ ভাবে ঋণ দিয়ে উত্তরা ব্যাংককে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এছাড়া, ২০২১ সালে কোনোরকম নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এমডির আত্মীয় আব্দুল্লাহ আল নোমানকে উত্তরা ব্যাংক সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ হাউজের দায়িত্ব প্রদান করে তার মাধ্যমে শেয়ার গ্রামলিং করে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন রবিউল। উক্ত নোমানের দুর্নীতি ও অদক্ষতায় ব্যাংকের প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে অভিযোগ উঠে। বিষয়টি ধরা পড়লে কোনো তদন্ত ছাড়াই নোমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এ ছাড়া আরও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, লোকাল অফিস থেকে নাভানা গ্রুপের চেয়ারম্যান শফিউল ইসলামকে ১০০ কোটি টাকা, ট্রেড এগ্রোবীক্স ও ছানোয়ারা গ্রুপকে আলাদাভাবে শত কোটি, গুলশান শাখা থেকে ট্রেড এগ্রো এক্সেলকে শত কোটি টাকা, বৈদেশিক বাণিজ্যিক শাখা আলিব কম্পোজিটকে ১৫০ কোটি টাকা অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋণ প্রদান করা হয় যার বেশির ভাগই ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

বিএনপির ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের অন্তর্ভুক্ত উত্তরা ব্যাংকের সিবিএ নেতারা জানান, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তি দিয়েছেন এমডি রবিউল।
স্বাভাবিকভাবেই ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করা উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণের দাবিতে উত্তাল হয় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়। টানা বিক্ষোভের মুখে তিনদিন অফিসের কার্যক্রম বন্ধ রাখেন এবং ৬ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এমডি কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য সংস্থায় অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। পরে একটি বড় রাজনৈতিক দলের একজন নেতাকে ম্যানেজ করে টিকে থাকার জন্য এই রবিউল। 

এ প্রসঙ্গে উত্তরা ব্যাংক শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোসলেহ উদ্দিনকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, এক রাজনৈতিক নেতা শেখ রবিউল আলম ব্যাংকের এমডিকে নিজের শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন না করতে ব্যাংকটির সিবিএ নেতাদের চাপ দিতে থাকেন। কয়েক দফা আলোচনার পর উক্ত নেতার মধ্যস্থতায় গত ২২ আগস্ট দুপুরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ৪ জন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রশাসন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও সিবিএ নেতাদের মধ্যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন উক্ত নেতা। 

বৈঠকে অংশ নেওয়া উত্তরা ব্যাংক লিমিটেড শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসেনসহ একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবিউল হোসেন স্বপদে বহাল থাকতে দুই হাতের টাকা খরচ করছেন। এমডি রবিউল কর্মস্থলে যোগদানের পর সিবিএ এর সাথে সম্পাদিত আপসনামা অস্বীকার করায় কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করে। অভিযোগ উঠে ওই নেতাকে এমডি ৫ কোটি টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তারা এবং সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে ১ কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ আসে। অথচ সিবিএ নেতাদের সাথে রবিউল আলোচনা করে ব্যাংকে আসলেও গত ৬ আগস্ট থেকে ১৪ আগস্ট আন্দোলনের অভিযোগ তুলে কলা বাগান থানায় মামলা করে আদালতের মাধ্যমে পিবিআইকে তদন্তের ভার দেওয়া হয় মামলা নম্বর ২৫২/২৪ যা সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে।
গত ২৪ অক্টোবর সিবিএ কার্যালয়কে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে আবু মো. আহসানুল হাবিব অফিসার গ্রেড-২ লোকাল অফিসকে উচ্ছেদ পত্র দেওয়া হয়। যা শ্রম আইন পরিপন্থি। শুধু তাই নয়, শ্রম অধিকার খর্ব, ট্রেড ইউনিয়নকে ধ্বংস করা এবং চাকুরিচ্যুত করার লক্ষ্যে সিবিএ’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কার্যকরী সদস্যকে শোকজ নোটিশ প্রদান করা হয়।

এ বিষয় বিপ্লবী ছাত্রজনতার জানতে পারলে রবিউল হোসেনকে অপসারণের দাবিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেকের কাছেই তারা যোগাযোগ করলে এমডির অপসারণ করার জন্য গড়িমসি করছেন।

এমএ