কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী একশ দিনের পর্যবেক্ষণ জানালো টিআইবি
নতুন বাংলাদেশ, কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন ও পরবর্তী একশ দিনে নিজেদের পর্যবেক্ষণের বিষয়গুলো জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
রোববার (১৮ নভেম্বর) ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ১০০ দিনের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।
বিজ্ঞাপন
এসময় উপস্থিত ছিলেন, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, গবেষক মো.জুলকারনাইন, ফারহানা রহমান, মো. মোস্তফা কামাল।
আরও পড়ুন
পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে শাহজাদা এম আকরাম বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নজিরবিহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্বর্ণোজ্জ্বল অর্জন-রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে 'নতুন বাংলাদেশ' গড়ার অভূতপূর্ব সুযোগ; এ অভীষ্ট অর্জনে রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন অংশীজনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন; তবে চলার পথে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ১০০ দিনে সংস্কার, আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের তদন্ত ও বিচার, আর্থিক খাত, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ; এসব সিদ্ধান্ত, উদ্যোগ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার অংশ।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তথা রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় কৌশল ও রোডম্যাপ প্রণয়নের সুযোগ না নেওয়া, যা এখনো অনুপস্থিত রয়েছে।
আন্দোলনে সংঘটিত সহিংসতার বিচার প্রক্রিয়ায় অব্যবস্থা সুনির্দিষ্ট ও তথ্য-প্রমাণভিত্তিক মামলা দায়ের করার উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে।
ঢালাওভাবে শত শত মামলায় শত শত ব্যক্তিকে আসামি করার ফলে মূল অপরাধীর উপযুক্ত বিচারের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে।
পদত্যাগের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন নির্বাচন কমিশন, দুদক, মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন পুনর্গঠনে চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট সংস্কার কমিশনসমূহের কার্যক্রম চলাকালীন অব্যবস্থা দেখা গেছে।
টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অ্যাড-হক প্রবণতা, উপদেষ্টা পরিষদ গঠন ও দায়িত্ব বণ্টনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিতর্কিত।
প্রশাসন পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ়তা ও কর্মপরিকল্পনার ঘাটতি আছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারে দায়িত্বশীলদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বিদ্যমান; কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিবর্তন হয়েছে।
প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধানত উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অপসারণের মাধ্যমে দলীয়করণ থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা, যদিও দলীয়করণের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত বিধায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি বাড়ছে বলে শঙ্কা আছে।
অন্যদিকে রয়েছে এক দলীয়করণের স্থলে অপর দলীয়করণ প্রতিস্থাপনের উদ্বেগ; পদোন্নতি, পদায়নকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষেত্রে অসন্তোষ রয়েছে।
কর্তৃত্ববাদ পতনের ক্ষেত্রে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা পালন। অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ও রাজনীতি থেকে নিবৃত থাকার ভূমিকা ইতিবাচক। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব সত্ত্বেও শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিতে প্রত্যাশিত পর্যায়ে সেনাবাহিনীর ভূমিকার ঘাটতি রয়েছে।
টিআইবি বলছে, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের পক্ষ থেকে সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার প্রশ্নে কোনো কোনো মহলের ধৈর্যের ঘাটতি লক্ষণীয় তিন মাসেই সরকারের কার্যক্রম নিয়ে কোনো কোনো মহলের হতাশা আছে।
অনেক ক্ষেত্রে দলবাজি, দখলবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতি চলমান একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও দলীয়করণের পরিবর্তে আরেকটি দলীয়করণের প্রতিস্থাপন, হাতবদল; এ প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে।
রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিয়ে দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকা, যা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও রাষ্ট্র সংস্কারের মূল চেতনা ধারণ ও রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অভীষ্ট অর্জনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অবস্থান পরিবর্তন- প্রথমে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার কথা বললেও পরবর্তীতে দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি রয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার রাষ্ট্র সংস্কার হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনড় অবস্থান ও রাজনৈতিক সহনশীলতার ঘাটতি; বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে অতিরিক্ত ক্ষমতায়ন এবং বিভাজনের লক্ষণ দেখা গেছে।
কোনো কোনো গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ ও হুমকি-হামলাসহ একাধিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করার তৎপরতা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর হুমকির বিষয়টি নজরে এসেছে।অন্যদিকে অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা এবং নির্বিচারে অ্যাক্রিডিটেশন বাতিলের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সহযোগিতা ও সমালোচনার সুযোগ সার্বিকভাবে মুক্ত পরিবেশ ও বাক-স্বাধীনতার পরিচায়ক বিবেচিত হলেও একদিকে কোনো কোনো মহলের অতিক্ষমতায়ন ও তার অপব্যবহার এবং চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা অসাম্প্রদায়িক সম-অধিকারভিত্তিক ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের অভীষ্টের পথে অন্তরায় হবে।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিকাশ ও প্রভাব দৃশ্যমান অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে জেন্ডার, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে, যা বৈষম্যবিরোধী চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ভারত কর্তৃক কর্তৃত্ববাদ পতনের বাস্তবতা মেনে নিয়ে নিজেদের ভুল স্বীকারে ব্যর্থতার পাশাপাশি বরং উত্তরণ প্রক্রিয়াকে অস্থিতিশীল করতে ভারত থেকে পতিত সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড সর্বোপরি ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন সরকার ও দেশের জন্য উদ্বেগজনক।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রভাবশালী দেশ ও দাতা সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন, এবং অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তার আশ্বাস ও ঘোষণা এই সরকার তথা আন্দোলনের অভীষ্টের প্রতি আস্থার প্রকাশ হিসেবে মনে হয়।
প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক সহায়তা, বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফ এর মতো সংস্থার ঋণ সহায়তা প্রয়োজনীয় বিবেচিত হলেও সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি ও বিশেষ করে ইতোমধ্যে সুদসহ ঋণের ভারে জর্জরিত দেশবাসীর ওপর অতিরিক্ত বোঝার প্রভাব নিয়ে উদ্বেগের কারণ রয়েছে।
এএসএস/এমএসএ