বায়ু দূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ঢাকার বস্তিবাসী
ঢাকায় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বায়ুর ঘনত্ব বৈশ্বিক মানের চেয়ে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি। যা লেরেঞ্জিয়াল, হাঁপানি এবং শ্বাসনালীর বিভিন্ন রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
বুধবার (১৯ মে) প্রকাশিত ‘আরবান লোকালাইজড পল্যুশন ইন দ্য কন্টেক্সট অব ক্লাইমেট চেঞ্জ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।
বিজ্ঞাপন
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইয়ুথ এনভায়রনমেন্টাল ইনিশিয়েটিভ (বিওয়াইইআই) ও পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (পিএসটিসি) উদ্যোগে ‘দ্য ফিচার গ্রিন আর্থ’ প্রকল্পের আওতায় গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়।
বুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং (ইউআরপি) ডিপার্টমেন্ট ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইসিসিসিএডি) গবেষণাটি পরিচালনা করে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ এর জানুয়ারি পর্যন্ত গুণগত ও পরিমাণগত তথ্য নিয়ে মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করে এ গবেষণা পরিচালিত হয়।
ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, ঘরের ভেতর বায়ু দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস রান্নার জন্য ব্যবহৃত মাটির চুলা ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত বায়োগ্যাস। রান্নার সময় দীর্ঘক্ষণ ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসার কারণে নারীরা বায়ু দূষণে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হন।
ঢাকার প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, আভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ এবং কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তথ্য জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন ধলপুর সিটিপল্লী বস্তি এবং শ্যামপুরের ঢাকা ম্যাচ কলোনির মানুষের ওপর গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। এ দুটি বস্তি বিভিন্ন বায়ু দূষণকারী কলকারখানা যেমন: স্টিল মিল, প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি, মেলামাইন ফ্যাক্টরি, ইটভাটা দ্বারা বেষ্টিত।
গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন বুয়েটের আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আফসানা হক এবং আইসিসিসিএডির সমন্বয়ক সরদার শফিকুল আলম।
ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে আফসানা হক বলেন, ঢাকায় প্রায় পাঁচ হাজার বস্তি রয়েছে। যেখানে ৪০ লাখ মানুষ বসবাস করেন। জীবন ধারণের মৌলিক সুবিধাগুলো পাওয়া সেখানে বিরাট চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন তাদের বাস্তবতাকে করে তুলেছে আরও জটিল।
গবেষণার অংশ হিসেবে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক পল্যুশন স্টাডিজ (ক্যাপস) গবেষণা এলাকার পানি ও বায়ু পরীক্ষা করে।
বায়ু পরীক্ষায় দেখা গেছে, ধলপুরে বায়ুর ঘনত্ব পি.এম ১১৬.৯৬ µg/m3 ও পি.এম ১৬৪.৭১ µg/m3, এবং ঢাকা ম্যাচ কলোনিতে পি.এম ৮৩.৯৬ µg/m3 ও পি.এম ১৫৫.৫০ µg/m3। যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় নীতিমালা অনুযায়ী নির্ধারিত মান পি.এম ২.৫ µg/m3 এবং পি.এম ১০ µg/m3। সে হিসেবে নির্ধারিত মানের তুলনায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি ঘনত্ব এসব এলাকার বায়ুর।
পানি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, উভয় এলাকার নমুনা পানিই বিদেশি কণা দ্বারা দূষিত হয়ে মানদণ্ডের মাত্রা অতিক্রম করেছে। নমুনা পরীক্ষায় ই. কোলি (৭ কিংবা তার বেশি) এবং মোট কোলিফর্মের অগণিত কলোনির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। গবেষণা এলাকায় বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড এবং ক্লোরিন কনসেন্ট্রেশনের পরিমাণও অতিরিক্ত পাওয়া গেছে।
গবেষকরা বলেন, গবেষণা এলাকায় বসবাসরত স্থানীয়রা দীর্ঘসময় ধরেই পানি-সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যেমন- দূরবর্তী পানির উৎস, পানির সংকট এবং নিম্ন মান।
গবেষণা এলাকা দুটিতে, পানির উৎস এবং সরবরাহ হয় সাপ্লাই লাইন এবং ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে। কিন্তু পানির সরবরাহ থাকে অল্প সময়ের জন্য এবং প্রায়ই তা বিঘ্নিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব এলাকার নারীদের পানি সংগ্রহের জন্য ৫ থেকে ১০ মিনিট পথ হাঁটতে হয়। লাইনে দাঁড়িয়ে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় পানি সংগ্রহের জন্য। মাসে ৪০০-৫০০ টাকা বিল দিয়েও মেলে না যথাযথ মানের পানি।
গবেষণা প্রকাশ ও আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এইসব অর্জনের বিপরীতে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কমিউনিটি উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে হবে। বর্জ্য নিষ্কাশন, পানি সরবরাহ এবং পানি ও বায়ু দূষণ রোধে সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তি মালিকানাধীন খাতকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বুয়েটের উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার। সঞ্চালনায় ছিলেন পিএসটিসির নির্বাহী পরিচালক ড. নূর মোহাম্মদ। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, রাজউকের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম, ওয়াটারএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা জাহান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ এবং বুয়েটের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খান।
আরও উপস্থিত ছিলেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন পরিচালক আফরোজ মহল, প্রকল্প ব্যবস্থাপক মানিক কুমার সাহা, আইসিসিসিএডির পরিচালক অধ্যাপক সলিমুল হক এবং বুয়েটের ইউআরপি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুসলেহ উদ্দিন হাসান।
একে/এসকেডি/জেএস