চেসিস কিনে বাস বানাতে যাচ্ছে বিআরটিসি
বিদেশ থেকে বাস আমদানি করে দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীদের সেবা দিয়ে আসছে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (বিআরটিসি)। আমদানি করা একটি বাসের পেছনে কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। এবার সেই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে সংস্থাটি। বিআরটিসি নিজেরাই চেসিস (বাসের কাঠামো) কিনে বাস তৈরি করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় খরচ হবে কোটি টাকার কম।
দেশের কয়েকটি বেসরকারি অটোমোবাইল ওয়াকর্শপে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি এসি বাস বানাতে চেসিসের দাম বাদে ৩৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা লাগে। নন-এসি বাস বানানো যায় ২০ লাখ টাকার মধ্যে। তবে বাসে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে তার ওপর ভিত্তি করে মোট খরচ একটু কম-বেশি হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ এখনো চেসিস আমদানি-নির্ভর দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দেশীয় কোম্পানিগুলো চেসিস এনে বিক্রি করে। মান অনুযায়ী ৪০ থেকে ৭০ লাখ টাকায় ইঞ্জিনসহ চেসিস পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন
কোন বাসে কত খরচ?
বিআরটিসি বলছে, বিদেশ থেকে আমদানি করা ভালো মানের এক ইউনিট নন-এসি বাসের আনুমানিক মূল্য ৬৬ হাজার ডলার। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ৩৫ শতাংশ সিডি/ভ্যাট ২৩ হাজার ১০০ ডলার এবং ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ৬ হাজার ৬০০ ডলার। সবমিলিয়ে একটি বাস দেশে আনতে খরচ হয় ৯৫ হাজার ৭০০ ডলার। ডলার প্রতি ১১৮ টাকা ধরে বর্তমানে একটি বাসের দাম পড়বে এক কোটি ১২ লাখ ৯২ হাজার ৬০০ টাকা।
বিপরীতে দেশে বানানো হলে খরচ কোটি টাকার নিচে নেমে আসবে। যেমন- ভারতের অশোক লেল্যান্ডের ইঞ্জিনসহ একটি চেসিসের দাম সাড়ে ৪৪ লাখ টাকা। অন্যান্য মালামালসহ বাসের বডি বানাতে খরচ হবে আরও ৪০ লাখ টাকা। ফলে ওই চেসিস দিয়ে একটি বাস বানাতে খরচ হবে সাড়ে ৮৪ লাখ টাকা। আমদানি করা বাসের চেয়ে প্রায় ২৮ লাখ টাকা কম পড়বে।
অন্যদিকে জাপানের হিনো মোটরসের ওয়ান-জে ইঞ্জিনসহ একটি চেসিসের দাম ৫৩ লাখ টাকা। অন্যান্য মালামালসহ বাসের বডি বানাতে খরচ হবে আরও ৪০ লাখ টাকা। ফলে এ ধরনের একটি বাস বানাতে খরচ হবে সাড়ে ৯৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রেও আমদানির তুলনায় ২০ লাখ টাকার মতো কম লাগবে।
এসি বাসের বিষয়ে বিআরটিসি জানিয়েছে, বিদেশ থেকে আমদানি করা এক ইউনিট এসি-বাসের আনুমানিক দাম এক লাখ ৪০ হাজার ডলার। এর সঙ্গে যুক্ত হবে ৩৫ শতাংশ সিডি/ভ্যাট ৪৯ হাজার ডলার এবং ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ১৪ হাজার ডলার। সবমিলিয়ে একটি বাস দেশে আনতে খরচ হবে দুই লাখ তিন হাজার ডলার। ডলার প্রতি ১১৮ টাকা ধরে ওই বাসের দাম আসে দুই কোটি ৩৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।
আমদানি না করে বিআরটিসির ওয়ার্কশপে একটি এসি-বাস বানালে খরচ হবে এক কোটি টাকারও নিচে, ৯৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাসের ইঞ্জিনসহ চেসিসের দাম ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং এটির ওপর অন্যান্য মালামালসহ বডি বানাতে খরচ হবে ৪৮ লাখ টাকা।
গত ২৯ অক্টোবর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের এক সমন্বয় সভায় বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন বিআরটিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হকের অফিসিয়াল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, নিজস্ব ওয়ার্কশপ ও নিজস্ব কর্মী দিয়ে বাস বানানোর বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ।
বন্ধ হওয়ার উপক্রম থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিআরটিসি
বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২১ সালের আগে প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সেখান থেকে বিআরটিসি এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ২০১২ সাল থেকে বন্ধ থাকা বিআরটিসির গাজীপুরের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কশপ এখন আধুনিক ওয়ার্কশপ হয়েছে। তেজগাঁও ওয়ার্কশপসহ প্রতিটি ডিপোর ওয়ার্কশপে এখন নিয়মিত কাজ চলে। বিভিন্ন সেক্টরের নিজস্ব দক্ষ কর্মীরা বেতনভুক্ত হয়ে এখানে কাজ করছেন। গত কয়েক বছরে প্রশিক্ষণ দিয়ে ৩০০ জনের বেশি দক্ষ কর্মী গড়ে তুলেছি। আমাদের গাড়িগুলোও এখন আর দিনের পর দিন বসে থাকে না। ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে যখন গাড়িগুলো রাত ৮টার দিকে ডিপোতে যায়, সেগুলো রাতের মধ্যে ঠিক করা হয়।
তিনি বলেন, অনেকে মনে করেন সরকারি কাজের কোয়ালিটি কম। কিন্তু বিআরটিসির কোয়ালিটি এই মুহূর্তে কোনোভাবেই কম নয়। আমি যখন আসলাম তখন প্রত্যেক মাসেই গাড়ি বসে যেত, এখন কোনো গাড়ি বসে পড়ে না। কারণ, মেরামত দক্ষ হাতে করা হয়। আমরা বলতে পারি— দেশে অন্যান্য যেসব ওয়ার্কশপে বেসরকারিভাবে বাস প্রস্তুত হয়, তাদের চেয়ে আমরা কোনো অংশে কম নই।
প্রাথমিকভাবে দুটি চেসিস কিনে গাড়ি তৈরির কাজ শুরু করবে বিআরটিসি
বিআরটিসি গাড়ি তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে দাবি করেছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, নিজেদের মানুষ দিয়ে এই মুহূর্তে আমরা নিজেরাই গাড়ি তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছি। গত ২৯ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ে সমন্বয় সভায় আমরা একটি প্রেজেন্টেশন দিয়েছি। এটি মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে এবং অনুমোদন দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয় থেকে আদেশের চিঠি পেয়েছি। আগামী সপ্তাহের দিকে আমরা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাব। চেসিসের জন্য লোকাল টেন্ডারে এগোব। প্রাথমিকভাবে আমরা দুটি চেসিস কিনে গাড়ি তৈরির কাজ শুরু করব। এটি করা হবে আমাদের গাজীপুরের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কশপে। এটি কন্টিনিউয়াস প্রসেসের মধ্যে থাকবে। আমরা একটা হিসাব করে দেখেছি— বছরে ৪০টি গাড়ি বানাতে পারব। এতে আমাদের যে আমদানি-নির্ভরতা, সেটি কমে যাবে। আমরা টেকসই উন্নয়নের দিকে যাব।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেকেই চেসিস বিক্রি করে। টেন্ডারে যার কাছ থেকে কম দামে নিতে পারব, তার কাছ থেকেই চেসিস নেব। আমাদের এই খবরে আকিজ মটরস, ইফাদ মটরস, এইচএনএস অটোমোবাইলসহ ছয়টি দেশীয় কোম্পানি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এগুলো ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে হবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা বাজারে খবর নিয়ে জেনেছি— ৪২ থেকে ৪৫ লাখ টাকার মধ্যে চেসিসগুলো কেনা যাবে। বাকি টাকা খরচ হবে বডি, সিট ও এসিতে। গাড়ি বানাতে কিন্তু আমাদের কোনো মিস্ত্রী খরচ হবে না। কারণ, আমাদের কর্মীরা নিয়মিত বিআরটিসি থেকে বেতন পাচ্ছে, তারাই এই গাড়ি বানাবে। চেসিস পেলে আমরা দুই মাসের মধ্যে গাড়ি বানিয়ে ফেলতে পারব। আমরা বলতে পারি, আগামী তিন মাসের মধ্যে আমাদের বহরে বিআরটিসির বানানো নিজস্ব বাস থাকবে।
এমএইচএন/এমজে