অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, আজকে বাংলাদেশে আমরা ঔপনিবেশিই দেখছি; ধনীদের ঔপনিবেশি। ঔপনিবেশিক শাসকরা যেমন এদেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করত, দেশকে তারা নিজেদের দেশ মনে করত না। আজকে বাংলাদেশের ধনীরা সেই কাজই করেন। কাজেই রাষ্ট্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি চরিত্রগতভাবে। 

রোববার (১০ নভেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আ ফ ম মাহবুবুল হক স্মৃতি সংসদের আয়োজনে বাসদ আহ্বায়ক কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হকের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে বামপন্থিদের ভূমিকা এবং করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আইয়ুববিরোধী ৬৯’র যে অভ্যুত্থান সে অভ্যুত্থানের চালিকা শক্তি ছিল বামপন্থিরা। এর সূত্রপাত মাওলানা ভাসানী করেছিলেন। তিনিই ছিলেন এর পরিচালক। বামপন্থিদেরই এখানে বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা ৭০ এর নির্বাচনে কি দেখলাম, ক্ষমতা চলে গেল বুর্জুয়াদের হাতে। রাষ্ট্র ভাঙলো না, রাষ্ট্র বদলাল না। রাষ্ট্র ৪৬ এ বদলায়নি, রাষ্ট্র ৭১ এ বদলায়নি। রাষ্ট্র যা ছিল সেটাই রয়ে গেছে এবং যে ঔপনিবেশিকতা ছিল ব্রিটিশ আমলে পাকিস্তানিরা এসে সেরকমই একটা নতুন অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশি তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। সেই ঔপনিবেশের বিরুদ্ধেই লড়াই হচ্ছিল এবং সেই লড়াইয়ের প্রধান ছিল বামপন্থিরা। কিন্তু তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। তার একটা বড় কারণ ছিল বিভাজন, চীনপন্থি এবং রুশপন্থি বিভাজন। সেটাতে কত বড় ক্ষতি হয়েছে সেটা আমরা পরিমাপ করতে পারব না। রাষ্ট্র ক্ষমতা বুর্জুয়াদের হাতে চলে গেল এবং সেই বুর্জুয়ারাই তারপর থেকে শাসন করতে থাকল। 

তিনি বলেন, এখন রাষ্ট্র তো বদল হয়নি, রাষ্ট্র তো একই রাষ্ট্র রয়েছে। তার আইন কানুন মিল, তার শুধু নামে বদলেছে আয়তনে ছোট হয়েছে। যদি বলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে একটা অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশ ছিল জমিদারদের ঔপনিবেশ। আজকে বাংলাদেশে আমরা ঔপনিবেশিই দেখছি; আরেক ধরনের ঔপনিবেশ, ধনীদের ঔপনিবেশ। ঔপনিবেশিক শাসকরা যেমন এদেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করত, দেশকে তারা নিজেদের দেশ মনে করত না। আজকে বাংলাদেশের ধনীরা সেই কাজই করেন। তারাই-তো আমাদের সম্পদ পাচার করে, ব্যাংক লুট করে, লুণ্ঠন করে। আর যতভাবে পারে অর্থ সঞ্চয় করে। কাজেই রাষ্ট্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি চরিত্রগতভাবে। বানর যদি মানুষের পোশাক পরে তাহলে কী সে মানুষ হয়ে যায়? ওই পোশাক পরলেই কি বানর মানুষ হয়ে যাবে? রাষ্ট্রতো ওই বানরই রয়ে গেছে। তার পোশাক বদল হয়েছে, রাষ্ট্রের পরিবর্তন হয়নি। 

সিরাজুল ইসলাম বলেন, এখন যে অভ্যুত্থান ঘটলো সেই অভ্যুত্থানে কোনো বিপ্লব ঘটেনি। একটা চরম ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। এই পতন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ঘটতো, ঘটতে পারতো। তাহলে আজকে যারা পলাতক রয়েছে তাদের পালাতে হতো না, তারা বেঁচে যেত। কিন্তু তারা সেটা চায়নি বলেই এই অভ্যুত্থান হয়েছে। একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে। আজকে সারা পৃথিবীজুড়েই পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদের রূপ নিয়েছে। 

২৪-এর আন্দোলন কোনো বিপ্লব নয় এটা গণঅভ্যুত্থান এমন মন্তব্য করে সভায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, মানুষের মধ্যে অহেতুক একটা বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে যে, ২৪ এর আন্দোলন একটা বিপ্লব। এটা কোনো বিপ্লব নয়, এটা অভ্যুত্থান। অনেক আন্দোলন আমরা করেছি, আর গণপ্রবর্তনকে চিহ্নিত করানো কিছু উপায় আছে। এর প্রথমটা হচ্ছে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেমে পড়ে। সমাজ ইতিহাসের একটা নিয়ম হলো মানুষের চেতনা অসমভাবে বিকশিত হয়। সবার চেতনা এক সঙ্গে বিকশিত হয় না। তবে গণঅভ্যুত্থানের সময় একেবারে নিম্নস্তরের চেতনা সম্পন্ন মানুষও সামনে চলে আসে, এটা হলো একটা লক্ষণ। আর দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে তাদের মধ্যে সৃজন ক্ষমতা বিকাশ পেতে থাকে। 

তিনি আরও বলেন, হাসিনা খালেদাকে তো দেখা হয়ে গেছে। কিংবা আরো ভাল করে বললে নৌকা, লাঙল, পাল্লা, শিষ সব সাপেরই দাঁতে বিষ; দেখা হয়ে গেছে। মুসলমানরা যখন নামাজ আদায় করে তখন প্রথমে ডান দিকে সালাম দেয় পরে বাম দিকে সালাম দেয়। তাই জিন্দেগি ভরা যদি ডানদিকে সালাম দিয়ে বসে থাকেন তাহলে তো আপনার নামাজ হবে না। এবার একটু বা দিকে সালাম ফেরান। আসলে বামপন্থা ছাড়া এদেশকে রক্ষা করা সম্ভব না।

সভায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দেওয়ালের গ্রাফিতিগুলোর মধ্যে যে ভাব, ভাষা এবং তাগিদ আছে তার কোনো প্রতিফলন আমরা সরকারের মধ্যে দেখছি না। সরকারের ভূমিকা এবং তৎপরতার সঙ্গে দেয়ালের গ্রাফিতির মধ্যে ও আন্দোলনের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষাগুলো তৈরি হয়েছে তার একটা বড় অসংগতি দেখা যাচ্ছে। আমি মনে করি দেয়ালের লেখাটাই হচ্ছে সমাজের সেই শক্তির প্রকাশ, যেই শক্তি একটা বড় ধরনের মৌলিক পরিবর্তন চায়। আর সেই মৌলিক পরিবর্তনের ভাষাটা যদি আমরা বুঝতে পারি। এবং সেই ভাষা বুঝে যদি একটি সাংগঠনিক প্রস্তুতির মাধ্যমে নিজেদের পুনর্গঠন করে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে। তাহলে নিশ্চই একটা বড় পরিবর্তনের দিকে আমরা যেতে পারব।

এসময় সভায় সভাপ্রধান হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আবু সাঈদ খান। সভায় আলোচক হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, হারুনুর রশীদ ভুইয়া, নাসির উদ্দিন আহমেদ নসু, মহিউদ্দিন চৌধুরী লিটন প্রমুখ। 

ওএফএ/জেডএস