বুথফেরত জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করে রিপাবলিকান পার্টির হয়ে ভূমিধস বিজয় অর্জন করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২৭০ ইলেক্টোরাল কলেজের ম্যাজিক ফিগার অতিক্রম করে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউসের টিকিট কনফার্ম করেছেন। এর ফলে চার বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে আবার হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন তিনি।

সুদূর মার্কিন মুলুকে ট্রাম্পের বিজয়ের খবর এখন প্রাসঙ্গিক বাংলাদেশের সব মহলে। কেমন হবে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনূস সরকারের সম্পর্ক। সংশ্লিষ্ট বোদ্ধামহল বলছেন, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কের কিছুক্ষেত্রে পরিবর্তন আসার পাশাপাশি কাজ করার ধরনে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে মোটাদাগে আমূল পরিবর্তন আনবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল দেশটির বৈদেশিক নীতিতে কোনো প্রভাব বিস্তার করে না। দেশটিতে নিজেদের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়িত হয়। তবে বিশ্বের কোথাও তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রশাসনিক টিম গোছাতে সময় নেবেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো একটা ছোট রাষ্ট্র ট্রাম্পের রাডারে আসতে কিছুটা সময় লাগবে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ডেমোক্রেটদের সখ্য পুরোনো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়া ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে শুরু করেছেন প্রথম বিদেশ সফর। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো দেশের শীর্ষ নেতার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের তেমন নজির নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন বিরল ঘটনা ঘটেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ড. ইউনূসকে কাছে পেয়ে বুকে টেনে নেন। হাতে হাত রেখে বলেন, বাংলাদেশের সংস্কারের যে লক্ষ্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ঠিক করেছেন, তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে হোয়াইট হাউস।

দেশ গঠনে হোয়াইট হাউস থেকে ড. ইউনূস যে সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছেন তা ডেমোক্রেটদের কাছ থেকে। এখন হোয়াইট হাউসের দেখভাল করবেন রিপাবলিকানরা। এক্ষেত্রে ড. ইউনূস এখন হয়ত আর হোয়াইট হাউসের অবাধ সমর্থন পাবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্সি পরিবর্তনে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না। যা আছে, সে রকম থাকবে। তবে কিছুটা শ্লথ গতি হয়ে যেতে পারে। নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে যে গতির সঞ্চার হয়েছে, সেটা কিছুটা স্তিমিত হতে পারে। কিন্তু একেবারে উল্টে যাবে—এ রকম মনে করার কোনো কারণ নাই। কিছুটা স্লো হয়ে যেতে পারে। তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আরেকটু বেশি সচেষ্ট হতে হবে।

মুন্সি ফয়েজ মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সক্রিয়তা কিছুটা কমে আসতে পারে। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট। তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে চিন্তিত। সেগুলো নিয়ে কাজ করেন, আগেও এমটনাই দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব জায়গায় তার সন্দেহ লেগেছে সেগুলোর গুরুত্ব কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। যেমন, আগের প্রেসিডেন্সিতে তিনি ন্যাটো ছোট করে ফেলার চেষ্টা করেছেন। ন্যাটোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন কমিয়েছেন, এবারও সেটা করতে পারেন। যুদ্ধ থেকে সরে আসার তার একটা চেষ্টা আমরা দেখেছি। আমি মনে করি এবারও তিনি এটা করবেন।

‘ট্রাম্পের বেশি দৃষ্টি থাকবে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও অন্যান্য বিষয়ে। সে কারণে বাংলাদেশ তাদের রাডারের অনেক নিচে অবস্থান করছে। আমাদের রাডারে হয়ত তারা বড় অবস্থানজুড়ে আছে কিন্তু তাদের রাডারে আমাদের অবস্থান অনেক নিচে। গুরুত্বটা অনেক কম।’ যোগ করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।

নির্বাচিত হওয়ার আগে ইউনূস সরকারকে নিয়ে বেশ সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প। গত ৩১ অক্টোবর এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশটিতে দলবদ্ধভাবে তাদের ওপর হামলা ও লুটপাট চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন পুরোপুরিভাবে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে রয়েছে।’

ট্রাম্প আরও লেখেন, ‘আমরা আপনাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করব। আমার প্রশাসনের সময় ভারত ও আমার ভালো বন্ধু প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর অংশীদারত্ব আরও জোরদার করব।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মোটা দাগে কোনো পরিবর্তন হবে বলে আমি মনে করি না। তবে বাংলাদেশ নিয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কাজের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রশাসনিক টিম গোছাতে সময় নেবেন। সেক্ষেত্রে আরেকটু অপেক্ষা করাই শ্রেয়।

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আবার বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজার কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রিপাবলিকানরা বেশি আগ্রহী। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মানবাধিকার। এটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ডেমোক্রেটরা বেশি আগ্রহী। অপরদিকে রিপাবলিকানরা বিষয়টি গুরুত্ব দেয়, কিন্তু ডেমোক্রেটদের মতো নয়। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির ক্ষেত্রে রিপাবলিকানরা গুরুত্ব কমাবে না বলে মনে হচ্ছে।

ইন্দো-প্যাসিফিক ‘লেন্স’ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখে আসছিল বাইডেন প্রশাসন। ট্রাম্পের আমলে ইন্দো-প্যাসিফিকে গুরত্বের বিষয়ে মুন্সি ফয়েজ বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক থাকবে। এটা চলে যাবে না। তবে আগের সরকার যেভাবে গুরুত্ব দিত সেটা কমবে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে ভালো দৃষ্টি দেবে তারা। ইন্দো প্যাসিফিক বা কোয়াডের মাধ্যমে না। তবে ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, নিষেধাজ্ঞা সেগুলোতে শক্ত ভূমিকা রাখবেন বলে আমার ধারণা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ। মার্কিন নির্বাচনের আগেও ট্রাম্প মোদিকে প্রশংসা করে টুইট করেছেন। বাংলাদেশে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কেউ কেউ এমন আলোচনা তুলছেন যে, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে হয়ত মোদীর পরামর্শে কিছুটা গুরুত্ব দেবেন বন্ধু ট্রাম্প। ভারতের চাপে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসন করার চেষ্টাও হতে পারে, বিশেষ করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করা হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

আসলেই কি এমন কিছু ঘটতে পারে? এ প্রশ্নে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজের ভাষ্য, আমার কাছে মনে হয় না ভারত এ রকম কিছু বলবে। ভারতের কী দায় ঠেকেছে? ওনাকে (শেখ হাসিনা) নিয়ে এরকম কিছু করতে গেলে ভারত নিজে বিব্রত অবস্থায় পড়বে আর বাংলাদেশও বিব্রত হবে। খুব জরুরি না হলে এ ধরনের কিছু হবে বলে মনে করি না, অন্তত খুব শিগগরিই না। ভারত চেষ্টা করবে মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে সেটাকে ব্যবহার করে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার।

এনআই/এসএম