শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন ও শিশুবান্ধব নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। শিশুদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে নিশ্চিত করতে হবে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এক মিলনায়তনে শিশু অধিকার সপ্তাহ-২০২৪ উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান থেকে এ আহ্বান জানানো হয়।

‘শোনো আগামীর কথা’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ। 

প্রায় দুই শতাধিক শিশুর প্রাণবন্ত অংশগ্রহণে বিশেষ এই সপ্তাহ উদযাপন করা হয়। শিশুদের বিকাশ ও সামগ্রিক উন্নয়নে ও সবাই মিলে আজকের শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার এটাই সময় বলেও মন্তব্য করেন অতিথি বক্তারা।

অনুষ্ঠানে শিশুরা একটি স্মারকলিপি পাঠের মাধ্যমে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু দাবি ও প্রত্যাশা তুলে ধরে। দেশের শিশুদের অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং তাদের সামগ্রিক বিকাশের জন্য শিশুরা সংশ্লিষ্ট সবার সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করে।     

নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা, একাডেমিয়া, সরকার-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে একটি আলোচনা সভা আয়োজিত হয়।

শিশুদের সঙ্গে যৌথভাবে আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির। এসময় শিশুদের সুষ্ঠু বিকাশ, সুরক্ষা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে রাষ্ট্র, সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিসহ সবার দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়।  

দেশের প্রচলিত আইনে বাল্যবিবাহকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ শিশু অ্যাকাডেমির (অতিরিক্ত সচিব) মহাপরিচালক তানিয়া খান লাইজু বলেন, ‘শিশুদের জন্য মানসম্পন্ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। বর্তমান পাঠ্যক্রমে আমরা এমন সংশোধন চাই, যেন শিশুরা পড়াশোনা উপভোগের পাশাপাশি সৃজনশীলতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং প্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত শিশুদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিদ্যালয়ে আধুনিক অবকাঠামো, উন্নত ও আধুনিক শিখন সামগ্রী, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার ব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশনের (ক্যাম্পি) রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “দেশে শিশুরাও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। শিশুদের মানসিক দিকটি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। গ্রাম পর্যায় থেকে শিশুদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে অনুপ্রেরণা দরকার।” 

শিশুদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি বলে উল্লেখ করেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির।

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই, শিশুদের জন্য কাজ করা সংগঠন এবং সরকারি সংস্থাগুলোতে শিশুদের প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হোক, যাতে তারা সরাসরি নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারে। শিশুদের জন্য এমন একটি অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে তাদের মতামতকে সম্মান জানানো হবে এবং নীতি-নির্ধারণে তা যথাযথভাবে বিবেচনা করা হবে।’

শিশুদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব নিশ্চিতে তাদের জন্য একটা বিশেষ অফিস থাকার পরামর্শ দিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, “শিশু অধিকার নিশ্চিতে দেশের আইন হচ্ছে শেষ আশ্রয়স্থল। বাল্যবিয়েসহ শিশু নির্যাতন-সহিংসতা রোধে দেশের প্রচলিত আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যাতে কোনোভাবে এই ধরনের অপরাধ বিচারের বাইরে না যায়।”

শিশুদের অধিকার নিশ্চিতে সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাদের একত্রে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে ডেনমার্ক দূতাবাস, বাংলাদেশের উপ-প্রধান অ্যান্ডার্স বি. কার্লসেন বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছেন নারী ও শিশুরা। শিশুদের সমতা নিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করতে হবে।” 

ইউনিসেফ বাংলাদেশের রিসার্চ অ্যান্ড ইভালুয়েশন ম্যানেজার ভারত গৌতম বলেন, “কত শতাংশ বাল্যবিবাহ হচ্ছে সেটার দিকে না গিয়ে আমরা কতটুকু প্রভাব রাখতে পারছি সেটা দেখতে হবে। আমরা সবাই মিলে কতটুকু উন্নতি করতে পেরেছি সেটা ভেবে দেখা দরকার। আমরা কি সব স্টেকহোল্ডার মিলে একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা নিতে পারি কী না শিশুদের অধিকার নিশ্চিতে। প্রতিটি শিশুর বিকাশ ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে আইন ও নীতির জায়গায় আমরা কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি সেসব কর্মপরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে।” 

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের গভার্নেন্স অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের প্রোগ্রাম ম্যানেজার লাইলা জ্যাসমিন বানু বলেন, “কমিউনিটি পর্যায়ে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রম বাড়াতে হবে। যেখানে বাচ্চারা ক্লাবের মতো সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অনেককিছু শিখতে পারবে যেখানে প্রতিবন্ধী শিশুরা প্রাধান্য পাবে। শিশুদের টেকসই উন্নয়নে এই ধরনের উদ্যোগ কার্যকরী হতে পারে।”      

পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে নানান রকম সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপস্থাপনা করে শিশুরা। শিশুদের অংশগ্রহণে সংগীত, নাট্য এবং নৃত্যের মাধ্যমে শিশু অধিকার, শিশু নির্যাতন এবং সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠান শেষে শিশুদের আঁকা ছবি, শিল্প ও প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন আগত অতিথিরা।  

এসময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অ্যাকশনএইড ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের চেয়ারপারসন ইব্রাহিম খলিল আল জায়াদ, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব এস এম শাফায়েত হোসেন, সিসিমপুর ওয়ার্কশপ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম, টিচ ফর বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনিয়া ইসলাম মুজুমদার সহ নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা, একাডেমিয়া, সরকার-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যমকর্মীরা।

জেইউ/এসএম