বাংলাদেশের সঙ্গে একটি নতুন অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি (পিসিয়ে) করতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তারই ধারাবাহিকতায় অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে প্রথম দফার আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে ঢাকা-ইইউ। আগামী নভেম্বরে ঢাকায় এ আলোচনা শুরু হবে।

চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে ইউরোপিয়ান এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিসের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পালা পামপালোনির নেতৃত্বে আগামী ৩ নভেম্বর ইইউর একটি প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফর করবেন। আগামী ৪ নভেম্বর ঢাকায় দুই পক্ষের মধ্যে যৌথ কমিশনের বৈঠক এবং ৫ নভেম্বর চুক্তির খসড়া নিয়ে প্রথম পর্বের আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত এই সূচিতে কিছুটা পরিবর্তন হতেও পারে।

ঢাকা ও ব্রাসেলসের কূটনৈতিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া ব্রাসেলস থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। এই চুক্তির আইনি কাঠামো হবে মানবাধিকার। এ চুক্তিতে সংযুক্তি, প্রতিরক্ষা, অন্তর্জাল নিরাপত্তা কাঠামোতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার মতো উপাদান থাকবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র-বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ইইউর নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার। ওই সাক্ষাতে তারা আসন্ন পিসিএ চুক্তি নিয়ে আলাপ করেছেন।

ব্রাসেলসের একটি কূটনৈতিক সূত্র বলছে, পিসিএ চুক্তি নিয়ে ঢাকা-ইইউর মধ্যে পাঁচটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। প্রথম দফায় আগামী নভেম্বরের শুরুর দিকে ঢাকায় বৈঠক হবে। ঢাকা-ইইউর কর্মকর্তারা আসন্ন বৈঠক নিয়ে কাজ করছেন। নভেম্বরে ঢাকার প্রথম বৈঠকের পর দ্বিতীয় বৈঠক হবে ব্রাসেলসে। খসড়া চুক্তিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে পর্যায়ক্রমে ঢাকা ও ব্রাসেলসে কয়েক দফায় আলোচনা হবে।

ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, ইইউর সঙ্গে পিসিএ চুক্তি চূড়ান্ত হলে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে প্রথম রাষ্ট্র, যারা সবার আগে ইউরোপের ২৭ দেশের জোটের সঙ্গে এই চুক্তি সম্পাদন করবে। পিসিএ চুক্তি মূলত, দুই পক্ষের মধ্যে একটি আইনগত সমঝোতা। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জলবায়ু, ইন্দো-প্যাসিফিকসহ সম্পর্কের সকল বিষয়ে সহযোগিতার জন্য চুক্তি করবে। এই চুক্তি হলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের বাজার অনেক বড় হবে। পাশাপাশি ইউরোপের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে উৎপাদনমুখী কার্যক্রম নিতে উৎসাহ পাবে। এছাড়া, ইউরোপের বাজারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের আরও একাধিক বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ নিতে পারবে।

অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির আওতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। সবশেষ, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ড ইইউর সঙ্গে পিসিএ চুক্তি করেছে।

বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আরও সম্প্রসারণ ও বিকাশের লক্ষ্যে গত বছরের ২৫ অক্টোবর নতুন ইইউ–বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন উপস্থিত ছিলেন।

ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে ৪০ কোটি ইউরো অর্থায়নের লক্ষ্যে ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাসের লক্ষ্যসমূহ অর্জন ও দেশের বিদ্যুৎ খাতের পরিবেশসম্মত টেকসই রূপান্তরের জন্য এই অর্থ খরচ করার কথা।

এছাড়া, আরও পাঁচটি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাবদ সাত কোটি ইউরোর চুক্তিও সই করা হয়। এ পাঁচটি ক্ষেত্র হলো শিক্ষা, শোভন কাজ, পরিবেশসম্মত নির্মাণশিল্প, ই–গভর্ন্যান্স ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা রোধ।

তারই ধারাবাহিকতায় গত সেপ্টেম্বরে (২০২৪) অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির প্রথম দফার আলোচনা শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির আলোচনা স্থগিত করে ইইউ।

পরবর্তীতে গত ১৯ সেপ্টেম্বর অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে ইইউ। ব্রাসেলস থেকে ঢাকায় ওই খসড়া পাঠানো হয়।

ঢাকার এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশ সঙ্গে ৫০ বছরেরও বেশি সময়ের সম্পর্কের শুরুতে ইইউ ছিল বাংলাদেশের কাছে দাতাগোষ্ঠী (উন্নয়ন অংশীদারিত্ব)। যা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক পর্যায়ে উন্নীত হয়। ২০০১ সালে ইইউর সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি করে বাংলাদেশ। সেই চুক্তিতে অর্থনীতি, উন্নয়ন, সুশাসন কিংবা মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। সময়ের ব্যবধানে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের সক্ষমতা বেড়েছে। অবস্থান আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়েছে। সবাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে চায়, আগ্রহ প্রকাশ করছে।

এই জ্যৈষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি করতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিছুদিন আগে তারা চুক্তির খসড়া ঢাকার সঙ্গে শেয়ার করেছে। শিগগিরই প্রথম দফার আলোচনা শুরুর কথা রয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে নভেম্বরের শুরুতে ঢাকায় ইইউর একটি প্রতিনিধিদল আসবে।

গত বছরের (২০২৩) নভেম্বরের মাঝামাঝিতে ইউরোপিয়ান এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিসের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর পাওলা পামপালোনি একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে ঢাকা সফর করেন। ওই সফরে পামপালোনি পররাষ্ট্র-বাণিজ্য ও শ্রম সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

বৈঠকে এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও ইইউর বাজারে বাংলাদেশের জিএসপি প্লাস সুবিধার পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ইইউকে জানায়—স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর যদি তৈরি পোশাক খাতের পণ্য তাদের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধার বাইরে থাকে তবে তা হবে অর্থহীন। তৈরি পোশাক খাতকেও শুল্কমুক্ত সুবিধার মধ্যে (জিএসপি প্লাস) যুক্ত করতে হবে।

এছাড়া, শ্রম ইস্যুতে জাতীয় কর্মপরিকল্পনার যে নয়টি টার্গেট আছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। ইইউকে ঢাকার পক্ষ থেকে জানানো হয়, কর্মপরিকল্পনার প্রায় ৮০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। ইইউ প্রতিনিধিদল ইইউ লেবার ল’ ডেপ্লয়মেন্ট প্রসঙ্গ তোলে। ঢাকার পক্ষ থেকে ইইউকে জানানো হয়—এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে কাজ করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৪ নভেম্বর ঢাকায় প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক সংলাপ করে বাংলাদেশ-ইইউ। ওই সংলাপে ইইউর পক্ষে ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এনরিকে মোরা নেতৃত্ব দেন। 

এনআই/এসকেডি