পরিচয় গোপন করে পাসপোর্ট নবায়ন ও জালিয়াতির অভিযোগে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

সোমবার (১৪ অক্টোবর) দুদকের উপ-পরিচালক হাফিজুল ইসলাম বাদী হয়ে সংস্থাটির সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি দায়ের করেন। সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

বেনজীর ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন— পাসপোর্টের সাবেক পরিচালক ফজলুল হক, মুন্সী মুয়ীদ ইকরাম, টেকনিক্যাল ম্যানেজার সাহেনা হক ও বিভাগীয় পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, বেনজীর আহমেদ ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর ডিআইজি হিসেবে কর্মরত থাকাবস্থায় হাতে লেখা পাসপোর্ট সমর্পণ করে বিভাগীয় অনাপত্তিপ ছাড়া অফিসিয়াল মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) জন্য আবেদন করেন। আবেদন ফরমে “অফিসিয়াল” হিসেবে মার্ক করা হয়। তার আবেদনপত্রের প্রফেশনের ক্রমিকে সরকারি চাকরিজীবী হওয়া সত্ত্বেও জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা, অপরাধমূলক অসদাচরণ ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রাইভেট সার্ভিস উল্লেখ করা হয়। পরে র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকাবস্থায়ও পাসপোর্টের আবেদনপত্রে জালিয়াতি-প্রতারণা, অপরাধমূলক অসদাচরণ ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে “প্রাইভেট সার্ভিস” উল্লেখ করেন। অন্যান্য সময়েও বিভাগীয় অনাপত্তিপত্র ব্যতীত মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি)/ই-পাসপোর্ট (ইলেক্ট্রনিক পাসপোর্ট) এর জন্য আবেদন করেছেন।

এজাহারে আরও বলা হয়, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের আসামিরা বেনজীর আহমেদের দাপ্তরিক পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত থেকেও অন্যান্য আসামিরা বিভাগীয় অনাপত্তি সনদ সংগ্রহ না করে কিংবা যাচাই না করে স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে তার নামে সাধারণ পাসপোর্ট কিংবা ই-পাসপোর্ট ইস্যুর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং দি বাংলাদেশ পাসপোর্ট অর্ডার ১৯৭৩ এর ১১ ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতির আরও একটি অভিযোগ দুদকে চলমান ছিল। গত ২৫ জুন এ বিষয়ে  যাচাই-বাছাই করতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের দুই অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও দুই পরিচালকসহ ১৫ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি পাসপোর্টে তার পুলিশ পরিচয় আড়াল করেছেন। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তিনি সরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে নীল রঙের অফিশিয়াল পাসপোর্ট করেননি। সুযোগ থাকার পরও নেননি লাল পাসপোর্ট। এমনকি বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে সাধারণ পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রেও আশ্রয় নিয়েছেন জালিয়াতির।

এ বছরের ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদিনের চেরাগ’ এবং ৩ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে একটি দৈনিক পত্রিকায় পরপর ২ দিন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের নানা অভিযোগ উঠে আসে। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

আর গত ২২ এপ্রিল বেনজীর, তার স্ত্রী জিসান মির্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে  দুদক। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বেনজীর আহমেদকে ৬ জুন এবং স্ত্রী জীসান মীর্জা ও দুই মেয়েকে ৯ জুন প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে দুদক। তবে তারা ওই তারিখে হাজির না হয়ে সময় চান।

এরপর দ্বিতীয় দফায় ২৩ ও ২৪ জুন তলব করা হয়। তখনও তারা হাজির না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে অভিযোগের বিপরীতে লিখিত বক্তব্য জমা দেন।

এর মধ্যে গত ২৩ ও ২৬ মে দুদকের দুই দফায় করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা বিভিন্ন সম্পত্তির দলিল, ঢাকার ফ্ল্যাট ও কোম্পানির শেয়ার জব্দের (ক্রোক) নির্দেশ দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। ২৩ মে তাদের ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি এবং ৩৩টি ব্যাংক হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়।

এরপর ২৬ মে তাদের আরও ১১৯টি স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন আদালত। এগুলোর মধ্যে রাজধানীর গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট, সাভারে একটি জমি ছাড়াও মাদারীপুরে ১১৪টি দলিলের সম্পত্তি রয়েছে। দুই দফা মিলিয়ে বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের ৬২১ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

আদেশ অনুযায়ী তাদের ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সিকিউরিটিজের (শেয়ার) টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়া, পুঁজিবাজারের ইলেকট্রনিক্স শেয়ার সংরক্ষণাগার সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানের নামে থাকা সব বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) ফ্রিজ করে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর বাইরে অন্যান্য সম্পদ জব্দের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জব্দকৃত সম্পত্তি দেখভালে ইতোমধ্যে রিসিভার নিয়োগ করা হয়েছে।

বেনজীরের পাসপোর্ট সংক্রান্ত ইতিহাস

১৯৮৮ সালে চাকরিজীবন শুরু করেন বেনজীর। তিনি তার পুরোনো হাতে লেখা পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন ২০১০ সালের ১১ অক্টোবর। সেসময় নীল রঙের অফিশিয়াল পাসপোর্ট না নিয়ে নেন সবুজ রঙের সাধারণ পাসপোর্ট। আসল পরিচয় আড়াল করে নিজেকে বেসরকারি চাকরিজীবী বলে পরিচয় দেন। আবেদন ফরমে পেশা হিসেবে লিখেন ‘প্রাইভেট সার্ভিস’।

দুদক সূত্রে জানা যায়, ওই বছরের ১৪ অক্টোবর বেনজীরকে নবায়নকৃত এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) দেওয়া হয়। যার মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ছিল ২০১৫ সালের ১৩ অক্টোবর। যদিও মেয়াদপূর্তির আগেই ২০১৪ সালে ফের বেনজীর পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন। কিন্তু এবারও যথারীতি নিজেকে বেসরকারি চাকরিজীবী বলে পরিচয় দেন। ২০১৪ সালে বেনজীর ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ছিলেন। এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও তিনি অফিশিয়াল পাসপোর্ট নেননি।

দ্বিতীয় দফায় নবায়নকৃত পাসপোর্টের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। পরে ২০১৬ সালে তিনি ফের পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন জমা দেন। সেসময় তিনি ছিলেন র‍্যাব মহাপরিচালক। সেবারও যথারীতি তিনি বেসরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দেন তার আবেদনে। সে দফায় পাসপোর্টে বেনজীরের তথ্য গোপন ও জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে যায়।

পাসপোর্ট অধিদপ্তরে সূত্র জানায়, র‍্যাব মহাপরিচালকের বেসরকারি পাসপোর্ট দেখে সংশ্লিষ্ট পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। কর্মকর্তারা পরে বিষয়টি পাসপোর্ট অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালকের নজরে আনলে বেনজীরের আবেদনপত্র আটকে যায়। তখন বেনজীরকে বিভাগীয় অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দাখিল করতে বলা হয়। কিন্তু এনওসি জমা না দিয়ে পাসপোর্ট নবায়নের চাপ দেন তিনি।

পরে সন্দেহজনক বিবেচনায় বেনজীরের বেসরকারি সাধারণ পাসপোর্ট গ্রহণের পক্ষে যথাযথ ব্যাখ্যা চেয়ে র‍্যাব সদরদপ্তরে চিঠি দেয় পাসপোর্ট অধিদপ্তর। কিন্তু এতে কাজ হয়নি। চাপের মুখে একদিনের ব্যবধানে তাকে পাসপোর্ট দেয় ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ (ডিআইপি)।

২০২০ সালে ৩০তম আইজিপি হিসেবে পুলিশ বাহিনীর প্রধান পদে দায়িত্ব নেন বেনজীর। নিয়মানুযায়ী সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট পাওয়ার কথা। কিন্তু বেনজীর মর্যাদাপূর্ণ লাল পাসপোর্টও নেননি। আইজিপি হয়েও তিনি ফের বেসরকারি চাকরিজীবী পরিচয়ে সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন করেন। সে সময় দেশে চালু হয় ই-পাসপোর্ট। বেনজীরের আবেদন নিয়েও দেখা দেয় জটিলতা। তা সমাধান করতে তিনি আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসে যাননি। অসুস্থতার কথা বলে পাসপোর্টের ডিআইপির মোবাইল ইউনিট চেয়ে পাঠান। পরে পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তার বাসায় গিয়ে ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ নেওয়াসহ সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালের ৪ মার্চ তার আবেদনপত্র জমা হয়ে যায়। ওই বছরের ১ জুন বেনজীরের নামে ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়।

আরএম/এসএম