বাংলাদেশের ব্যবসায়ী জগতের অন্যতম পথিকৃৎ এবং সফল শিল্পপতি ছিলেন শেখ আকিজ উদ্দিন। নামটির সঙ্গে পরিচিত নয় এমন মানুষ মেলা ভার। অবশ্য ‘আকিজ সাহেব’ নামেই তার পরিচিতি বেশি। তিনি একজন সত্যিকারের উদাহরণ যিনি একেবারে ‘শূন্য’ থেকে শুরু করে কোটিপতি হয়েছেন। কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা, সততা ও ধৈর্য একজন মানুষকে যে শূন্য থেকে শিখরে পৌঁছাতে পারে সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন শেখ আকিজ উদ্দিন। 

ব্যবসায়ী আকিজ উদ্দিনের ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক জীবনের অনেক ঘটনা প্রেরণাদায়ক। তার কোটিপতি হওয়ার গল্পের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও রহসম্যয় অংশ তার ‘ট্রেডমার্ক’ স্কুটার। এই স্কুটি তার জীবনের এক পরিচিত ও প্রতীকী অধ্যায় হয়ে আছে। হয়ে আছে কঠোর পরিশ্রম, সাদামাটা জীবন আর দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক।

আকিজ উদ্দিন ব্যবসায়ী জীবনের শুরুতে যে স্কুটার নিয়ে কারখানাগুলোতে যাতায়াত করতেন সেটি এখনও সযত্নে সংরক্ষণ করা রয়েছে রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের আকিজ-বশির গ্রুপের সিম্পলট্রি লাইট হাউজের নিচ তলায়। আকিজ-বশির গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছেন আকিজ উদ্দিনের ছেলে শেখ বশির উদ্দিন।

শেখ আকিজ উদ্দিনের কোটিপতি হওয়ার গল্পের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ও রহসম্যয় অংশ তার ‘ট্রেডমার্ক’ স্কুটার / ঢাকা পোস্ট

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সিম্পলট্রি লাইট হাউজের নিচতলায় অভ্যর্থনা টেবিলের পাশে শোভা পাচ্ছে নীল রঙের একটি স্কুটার। বাজাজের স্কুটারটির পেছনের নেমপ্লেটে লেখা রয়েছে ‘যশোর এ-৮৯২’। আর সামনে ইংরেজি অক্ষরে লেখা আছে ‘ভেসপা ১৫০’। এর পাশেই রয়েছে একটি স্তম্ভ। যাতে বাংলায় এবং ইংরেজিতে লেখা রয়েছে আকিজ উদ্দিন ও তার স্কুটারের নিবিড় সম্পর্কের কথা। ছোট্ট ওই স্তুতিবাণীতে লেখা আছে —

❝নিজ চেষ্টা ও অসীম কর্মপ্রেরণায় স্বনির্মিত
এক অনুপম ব্যক্তিত্ব শেখ আকিজ উদ্দিন।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে
একজন বিরাট শিল্পপতি হওয়ার পথে এই
বাহনটি সঙ্গী ছিল তার বহু বছর। প্রাচুর্যের
মাঝেও বিলাসিতাহীন কর্মমুখী জীবনের
শিক্ষা নিয়ে তিনি যেমন আদর্শ, তার এই
ভেসপাটিও যেন সেই সাফল্যগাথার প্রতীক হয়ে টিকে আছে।❞

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকিজ উদ্দিন নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগ করেন এবং ব্যবসার পরিধি বাড়ান, যা তাকে দীর্ঘমেয়াদি সফলতা এনে দেয় / ঢাকা পোস্ট

আকিজ-বশির গ্রুপের হেড অব মার্কেটিং মো. শাহরিয়ার জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প, সততা এবং ব্যবসায়িক উদ্ভাবন আকিজ উদ্দিনকে অনন্য শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। তার জীবন কাহিনী প্রমাণ করে, সীমিত সম্পদ নিয়ে শুরু করেও পরিশ্রম এবং সংকল্প থাকলে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। তিনি সবসময় ব্যবসায় সততার ওপর জোর দিতেন। সততা এবং সতর্ক দৃষ্টিতে ব্যবসা পরিচালনার কৌশল তাকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকিজ উদ্দিন নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগ করেন এবং ব্যবসার পরিধি বাড়ান, যা তাকে দীর্ঘমেয়াদি সফলতা এনে দেয়।

তিনি বলেন, এই নীল স্কুটারের বয়স ৫০ বছরের বেশি। এটি তার সফল ব্যবসায়িক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে আছে। প্রথম জীবনে যশোর থাকার সময় পাটের ব্যবসা করতে তিনি স্কুটারটি ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীতে ঢাকায়ও এই স্কুটার ব্যবহার করেছেন। তার পরিবারের সদস্যদের নানা স্মৃতি রয়েছে স্কুটারটি ঘিরে।

মাত্র ‘১৭ টাকা’ পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন শেখ আকিজ উদ্দিন

শেখ আকিজ উদ্দিনের জীবনের এক অসাধারণ গল্প হলো ব্যবসা শুরুর সময় তার পুঁজি ছিল মাত্র ‘১৭ টাকা’। সীমিত সম্পদ থেকে শুরু করে যে বিশাল সাফল্য অর্জন করা সম্ভব সেটি তিনি করে দেখিয়েছেন। 

জানা যায়, ১৯৪০ এর দশকে শেখ আকিজ উদ্দিন মাত্র ১৩ বছর বয়সে কাজের সন্ধানে কলকাতায় পাড়ি জমান। সেখানে তিনি বিভিন্ন ছোটখাটো কাজ করতেন। দেশে ফিরে এসে তিনি খুলনায় বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। তার হাতে তখন ছিল মাত্র ১৭ টাকা। যা দিয়ে তিনি তার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নিজের হাতে বিড়ি তৈরি করে তিনি নিজেই বিক্রি করতেন।

আকিজ গ্রুপ দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান / ঢাকা পোস্ট

পরবর্তী সময়ে ছোট্ট বিড়ির ব্যবসাকে নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে ক্রমশ বড় করে তোলেন তিনি। তার বিড়ির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং খুব দ্রুত তিনি এলাকার মধ্যে তার ব্যবসা প্রসারিত করেন। এরপর তিনি ‘আকিজ বিড়ি’ নামে একটি ব্র্যান্ড তৈরি করেন, যা পরে সারা বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়। বিড়ি ব্যবসায় সফলতার পর শেখ আকিজ উদ্দিন বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। তিনি ধীরে ধীরে টেক্সটাইল, সিমেন্ট, সিরামিক, খাদ্যপণ্য এবং আরও অনেক খাতে ব্যবসা প্রসারিত করেন।

১৯৭০ এর দশকে তিনি ‘আকিজ গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত।

শেখ আকিজ উদ্দিনের সফলতা নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছেন, ‘শেখ আকিজ উদ্দিন ৭৭ বছর বেঁচেছেন। তার মধ্যে ৬৮ বছর ব্যবসা করেছেন। তিন বছর পিতার সঙ্গে আর বাকি ৬৫ বছর একাই ব্যবসা করেছেন। তিনি আধুনিক অর্থে শিক্ষিত ছিলেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেছেন কিন্তু সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই তরুণ মাত্র ১৭ টাকা সম্বল হাতে নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করেন এবং কলকাতা ও পেশোয়ারসহ অন্য জায়গায় ব্যবসা শেষে আবার দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তার যে সৃজনশীলতা, সেটা তাকে কোথাও থেমে থাকতে দেয়নি । তিনি একটির পর একটি ব্যবসা করে ১৭ টাকার পুঁজি থেকে শত শত কোটি টাকার একটি শিল্পসাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তার এ সাম্রাজ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিড়ি তৈরি থেকে শুরু করে সিমেন্ট উৎপাদন, পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, সিগারেট শিল্প, খাদ্য ও পানীয়।’

‘শেখ আকিজ উদ্দিন : জীবন ও সময়’ নামে বইয়ে আকিজ উদ্দিনকে ধনী কোম্পানির গরিব মালিক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে / ঢাকা পোস্ট

তিনি আরও বলেন, ‘এই যে সাফল্য, সেটা আমাদের সামনে এই সত্য তুলে ধরে, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য শিক্ষিত হওয়ার চেয়েও বেশি প্রয়োজন বোধ হয় কল্পনাবিলাসী হওয়া। শেখ আকিজ উদ্দিনের এই কল্পনা করার ক্ষমতা আমাদের অত্যন্ত আকর্ষণ করে। শেখ আকিজ উদ্দিন যে শুধু উদ্যোক্তা হিসেবে সফল ছিলেন তা নয়, তিনি একজন গর্বিত সফল পিতাও। তিনি ১৫ সন্তানকে মানুষ করেছেন এবং তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে পরিণত করে বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন।’

সাদামাটা জীবন যাপনে খুশি ছিলেন আকিজ উদ্দিন

আকিজ উদ্দিন যখন ব্যবসায়িক জীবনে সাফল্যের শেখরে ছিলেন, তখনও তিনি সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিনি এই স্কুটার চালিয়ে তার কারখানায় যাতায়াত করতেন, যা তার সাধারণ জীবনের একটি বিশেষ অংশ ছিল। সাদাসিধে জীবনের কারণে তিনি কখনো অহংকার করেননি এবং কর্মচারীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন।

‘শেখ আকিজ উদ্দিন : জীবন ও সময়’ নামে এক বইয়ে তাকে ধনী কোম্পানির গরিব মালিক হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

‘শেখ আকিজ উদ্দিন : জীবন ও সময়’ / সংগৃহীত

এই বইয়ের পারিবারিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তিনি এতটাই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন যে, পাঞ্জাবিও তিনি কখনো ঈদ ছাড়া বানাতেন না। ঈদ উপলক্ষ্যে নির্দিষ্ট সাদা কাপড় দিয়ে তার পছন্দের একজন দর্জি পাঁচ-ছয়টা পাঞ্জাবি বানিয়ে দিতেন। কাছের মানুষরা জানিয়েছেন, দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠীর কর্তা হলেও তিনি ভোগবিলাসে গা ভাসাননি কখনোই। পোশাক থেকে শুরু করে শোবার ঘরের সাজসজ্জা পর্যন্ত সবকিছুতেই সাদামাটা ছিলেন তিনি।’

আবার পরিবারে তিনি সবসময় একটা কৃত্রিম সংকট রাখতেন, নিজেকে ভাবতেন সম্পদের কেয়ারটেকার। পারিবারিক খরচ চলত নির্দিষ্ট হিসাব মেনে।

আকিজ উদ্দিনের অনুপস্থিতিতে ব্যবসার হাল ধরেন সন্তানরা

২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর শেখ আকিজ উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন উদার মনের মানুষ। জীবদ্দশায় প্রচুর সমাজসেবামূলক কাজও করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। আকিজ উদ্দিনের মৃত্যুর পর তার সন্তানরা তাদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে সফলভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছেন।

২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর শেখ আকিজ উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন / সংগৃহীত

চরম দারিদ্র্য থেকে উঠে এসে ব্যবসায়িক জগতে সফলতা অর্জন করেছেন আকিজ উদ্দিন। প্রায় ৭০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কোম্পানিতে। 

আরএইচটি/এমজে