গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন হয় শেখ হাসিনার সরকারের। সেদিন সারা দেশে শত শত থানা জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা। চরম অবনতি হয় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। ভেঙে পড়ে পুলিশের ‘চেইন অব কমান্ড’।

আওয়ামী শাসনামালে পুলিশের শীর্ষ পদে থাকা অফিসাররা চলে যান আত্মগোপনে। জনজীবনে স্বাভাবিক গতি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় পুলিশের সংস্কার কাজ। তবে দুই মাসে এখনো ‘সংস্কার’ বলতে কিছু হয়নি। কর্মকর্তা পর্যায়ে প্রচুর রদবদল হয়েছে কেবল। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। সত্যিকারের সংস্কার হয়তো এখন দেখা যাবে। পুলিশে এখন চলছে সেই অপেক্ষা।

প্রথম ধাপে বড় রদবদল

প্রথমে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন পুলিশের সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে কর্মকর্তা পর্যায়ে রদবদল শুরু করেন। গত ৮ আগস্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের চুক্তি বাতিল করে নতুন আইজিপি হিসেবে মো. ময়নুল ইসলামকে নিয়োগ দেওয়া হয়। পুলিশ অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয় অতিরিক্ত আইজিপি ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলামকে। এসবি প্রধান হিসেবে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয় রেলওয়ে পুলিশের ডিআইজি মো. শাহ আলমকে।

সরানো হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মোহাম্মদ আলী মিয়াকেও। প্রাথমিক সংস্কারের এ ধারাবাহিকতায় একযোগে বদলি করা হয় ২৪ জেলার পুলিশ সুপারকে। বদলি করা হয় ডিএমপির ঊর্ধ্বতন পদমর্যাদার ৮ কর্মকর্তাকেও। তবে বাহিনীর কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় প্রয়োজন হয় অধিকতর সংস্কারের। প্রয়োজন দেখা দেয় পুলিশের জন্য প্রণীত বিভিন্ন আইনে সংযোজন ও বিয়োজনের। 

অঙ্কুরে বিনষ্ট সাখাওয়াতের পদক্ষেপ  

পুলিশের পাশাপাশি অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ পদেও পরিবর্তন আসে। আওয়ামী শাসনামালে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলির কারণে স্বভাবতই শীর্ষ পদে পরিবর্তন এসেছে। তবে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের পরিস্থিতি ছিল নাজুক, উদ্বেগ এবং ভীতির। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও পুলিশের অনেক সদস্য নিজ নিজ কর্মস্থলে এখনো যোগ দেননি। এক সপ্তাহের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন। তবে তিনি নানা পরিকল্পনা হাতে নিলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখার আগেই তাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ফলে পুলিশের সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।

খুঁড়িয়ে চলে প্রাথমিক সংস্কার, যুক্ত হন নতুন উপদেষ্টা  

অন্তর্বর্তী সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব)। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর আনসার বিদ্রোহের পাশাপাশি নানা সংকট দেখা দেয়। বঞ্চিতদের ব্যানারে বিভিন্ন দাবি দাওয়ার ভারে নুয়ে পড়ে সরকার। ফলে কার্যত পুলিশ সংস্কারের কাজ খুঁড়িয়ে চলতে থাকে। আনসার সদস্যদের সংকট মোকাবিলায় চলে দফায় দফায় বৈঠক। পরবর্তীতে আনসার বাহিনীর সংকট সমাধান হলেও পুলিশের নাজুক অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।  

সংস্কার কমিশন গঠনেই দুই মাস শেষ, সুপারিশ পেতে অপেক্ষা আরও তিন মাস

নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পর গঠন করা হয় পুলিশ সংস্কার কমিশন। সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনকে পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ কমিশনে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইকবাল, সাবেক বিভাগীয় কমিশনার ও যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শেখ সাজ্জাদ আলী, পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মো. গোলাম রসুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা, মানবাধিকারকর্মী এ এস এম নাসিরউদ্দিন এলান ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।

এ কমিশনের পক্ষ থেকে গত ৬ অক্টোবর সফর রাজ হোসেন বলেন, প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো পুলিশ আইন সংস্কারের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হবে। এ জন্য তিন মাসের মধ্যে সব পর্যায়ের মানুষের মতামত নেওয়া হবে। এরপর সুপারিশ পেলে শুরু হবে পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠন ও সংস্কারের কাজ।

সফর রাজ হোসেন বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। গত কয়েকদিন নিজেরা ইনফরমাল আলোচনা করেছি। আমি কীভাবে কী করব সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করেছি। পুলিশের বিষয়ে প্রচুর আইনের বই এবং নীতিমালা আমরা সংগ্রহ করেছি। আমাদের সঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞও রয়েছেন। এখন আমরা সবাই বসে একটা কর্মপরিকল্পনা করব।

তিনি বলেন, যেভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুলিশ তাদের কর্মপরিকল্পনা করে আমরাও তেমন একটি সুপারিশ করব। যে যে ধারা পরিবর্তন বা সংশোধন লাগবে সেসব বিষয় নিয়ে সুপারিশ থাকবে। আমরা একটি ওয়েবসাইট করারও চিন্তা করেছি। সময় আমাদের অল্প, মাত্র তিন মাস। আশা করছি, এই তিন মাসের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হবে।

সংস্কার কমিশনকে সব রকমের সহযোগিতার আশ্বাস 

পুলিশ সংস্কার কমিশনকে সব রকমের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব)। তিনি বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তারা যেসব সহযোগিতা চান সব সহযোগিতা দেবে সরকার। বেঁধে দেওয়া সময়ে প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব বলে আশা রাখি।

পুলিশ সংস্কার কমিশন; সর্ষের মধ্যে ভূত!

পুলিশ সংস্কার কমিশনে জায়গা পেয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ। এই আমলার এখানে জায়গা পাওয়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে থাকাকালীন সাদ উদ্দিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ১১০৬ কর্মকর্তাকে ১২০ কোটি টাকা খরচ করে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের আরও অভিযোগ রয়েছে। তিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেও তার সাবেক সহকর্মীরা অভিযোগ তুলেছেন।

এমএম/এসকেডি