নখদন্তহীন বাঘ কিংবা রাজনৈতিক হাতিয়ার হচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এমন বিশেষণ নিয়ে টিমটিম করে চলছিল রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হঠাৎ নড়েচড়ে বসেছে দুদক। অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগ সরকারের অন্তত ৭০ মন্ত্রী-এমপি, সাবেক শীর্ষ আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ব্যবসায়ী ও পুলিশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতির খোঁজে মাঠে নেমেছে সংস্থাটি।

শুধু তাই নয় তাদের নামে-বেনামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ করা শুরু করেছে। অনুসন্ধান কাজ আরও গতিশীল করতে অর্ধশত ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা। যদিও এরই মধ্যে অনেকে দেশত্যাগ করেছেন, কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন।

দুদক সূত্রে জানা যায়, অধিকাংশের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, ব্যাংকের ঋণ নিয়ে লুটপাট, অর্থপাচার, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, সরকারি ও বেসরকারি জমি-সম্পত্তি দখল, লুটপাটসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের চলমান দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সদ্য সাবেক ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপি ও আমলাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কাজ চলমান আছে। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়ায় কমিশন থেকে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আইন-বিধি অনুসরণ করে কাজ চলমান রয়েছে। এটা প্রমাণিত দুদক স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ পেলে অবশ্যই ভালো কিছু করে দেখাতে পারবে। মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হবে।

তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এলে গোয়েন্দা ইউনিট থেকে সেসব অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে প্রকাশ্যে অনুসন্ধান শুরু করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে দুদক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পটপরিবর্তনের পর দুদকের সাম্প্রতিক তৎপরতা দুইভাবে দেখা উচিত। একটি হচ্ছে প্রাক্তন মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিদের বিতর্কিত যেসব ঘটনা ছিল সরকার পতনের পর সেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। আরেকটি হচ্ছে এখন যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাদের বিষয়ে দীর্ঘদিন আগে থেকেই তথ্য ছিল। যা আমরা টিআইবির গবেষণায় দেখিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা দেখিয়েছি কীভাবে জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তখন দুদক কিন্তু পদক্ষেপ নেয়নি। যতটুকু জানা যায় পটভূমি পরিবর্তনের পর আগের ওই তথ্যের ভিত্তিতে এখন পদক্ষেপ নিচ্ছে। বর্তমানে শতাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এর ফলাফল যাই হোক না কেন, দুদককে যে ঢেলে সাজাতে হবে এর প্রয়োজনীয়তা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই।

যাদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান

বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগে ধীরে ধীরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে ধরা পড়ছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। দুদক উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম ১৩ জন সাবেক মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে।

অভিযুক্তরা হলেন- সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ, সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমেদ, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্‌মুদ চৌধুরী, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন, কুষ্টিয়া-১ আসনের সাবেক এমপি সরওয়ার জাহান, মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, যশোর-১ আসনের সাবেক এমপি শেখ আফিল উদ্দীন, রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক এমপি এনামুল হক, জয়পুরহাট-২ আসনের সাবেক এমপি আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ও বাগেরহাট-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল।

দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে অপর একটি অনুসন্ধান টিম আরও ১৩ সাবেক মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে। তারা হলেন- সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, ধর্ম বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী ফরিদুল হক খান, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জাসদ নেতা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, ঢাকা-২০ আসনের সাবেক এমপি বেনজীর আহমেদ, যশোর-৩ আসনের সাবেক এমপি কাজী নাবিল আহমেদ, পটুয়াখালী-৪ আসনের সাবেক এমপি মহিববুর রহমান এবং নাটোর-১ আসনের সাবেক এমপি শহিদুল ইসলাম বকুল।

ওই একই টিম সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তার ছেলে শাফি মোদাচ্ছের খান, মন্ত্রীর সাবেক পিএস অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশিদ বিশ্বাস, যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, সহকারী একান্ত সচিব মনির হোসেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুসহ ১০ ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়েও অনুসন্ধান করছে।

এ ছাড়া, আরও ১৪ ভিআইপির দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে দুদকের উপ-পরিচালক ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি টিম অনুসন্ধান কাজ করছে। তারা হলেন- সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, সাবেক শিল্পমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান ও সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিম, মামুনুর রশিদ কিরণ, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, কাজিম উদ্দিন, নুর-ই-আলম চৌধুরী ও জিয়াউর রহমান।

গত দুই মাসে আরও অনেক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তারা হলেন- সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সাবেক সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু, নিজাম উদ্দিন হাজারী, নিক্সন চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, বেনজীর আহমেদ, ড. জান্নাত আরা তালুকদার হেনরী, অসীম কুমার উকিল, অপু উকিল, শাহে আলম তালুকদার, ডা. মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম আজাদ, সোলায়মান হক জোয়াদ্দার (ছেলুন), ইকবালুর রহিম, মো. সাইফুজ্জামান শেখর, তানভীর ইমাম, এনামুল হক, মো. আখতারুজ্জামান বাবু, শফিকুল ইসলাম শিমুল, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ হাবিব হাসান, মো. নুরুল ইসলাম তালুকদার, আব্দুল ওদুদ, আয়েশা ফেরদৌস, রনজিত কুমার রায়, সাদেক খান, গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স, মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, নাছিমুল আলম চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা, মো. আবু জাহির, এইচবিএম ইকবাল, সোলায়মান জোয়ার্দার, শাহীন চাকলাদার, এইচএম ইব্রাহিম ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে তমাল মুনসুর।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র জহুরুল ইসলাম চাকলাদারে বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক।

এ ছাড়া, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামাল, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ, সাবেক ডিআইজি আব্দুল বাতেন, ডিআইজি জামিল হাসান, এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) টি এম জোবায়ের, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকু, বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস, বিসিআইসির সাবেক চেয়ারম্যান হাইয়ুল কাইয়ুম ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দ্বিতীয় সচিব আরজিনা খাতুনের দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে।

দুদক নোয়াখালীর কবিরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র জহিরুল হক রায়হান, কবিরহাটের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুন নাহার শিউলি, ৩ নং ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল কন্ডাক্টর, নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিন বিএসসি, নোয়াখালী উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও ২নং সুন্দলগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নূরুল আমিন রুমি, রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. মুছা মাতব্বর, সহ-সভাপতি বৃষকেততু চাকমা, অংসিপ্রু চৌধুরী ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক রেমলিয়ানা পাংখোয়ার দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করেছে।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুনাজ আহমেদ নূর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিরীন আখতারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

দুদকের জালে পড়েছেন আলোচিত বিতর্কিত তিন ব্যবসায়ীও। যাদের মধ্যে গত ১৫ আগস্ট এস আলম গ্রুপের এস আলম ও ব্যবসায়ী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। এরপর ২২ আগস্ট সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় দুদক। সংস্থাটি প্রমাণ পায়, তারা আর্থিক খাত থেকে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন।

আরএম/এমজে