সংবিধান অনুযায়ী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নির্ধারণ করা থাকলেও মাত্র আড়াই বছরেই বিদায় নিতে হয়েছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি)। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আউয়াল কমিশনকে বিভিন্ন মহলের চাপ সহ্য করতে হয়েছে মাসখানেক।

রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ চেয়ে না পেয়ে হতাশায় পত্রিকায় একটি নিবন্ধনও লেখেন সাবেক সিইসি হাবিবুল আউয়াল। তারপরও রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ পায়নি নির্বাচন কমিশন। এরপর বাধ্য হয়েই কমিশনের সবাই একমত হয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগ করেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজেদের অবস্থান ও করণীয় জানতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় আউয়াল কমিশন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো ইসির সংস্কার করা হবে বলে নিশ্চিত করে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের এমন ঘোষণার পরই মানসিকভাবে পদত্যাগের প্রস্তুতি নেয় আউয়াল কমিশন।

পদত্যাগ করে এক মুহূর্তও দাঁড়াননি হাবিবুল আউয়াল

গত ৫ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় নির্বাচন কমিশনের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগের ঘোষণা দেয় পুরো কমিশন। ঘোষণা দিয়েই সংবাদ সম্মেলনের শেষে পদত্যাগপত্রে সই করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। পদত্যাগের পর আর এক মুহূর্তের জন্যও ভবনে দাঁড়াননি তিনি। 

বিএমডব্লিউ রেখে বন্ধুর পুরোনো গাড়িতে ইসি ছাড়েন সিইসি

পদত্যাগ করে বন্ধুর পুরোনো গাড়িতে ইসি ছাড়েন হাবিবুল আউয়াল। এদিন তিনি নিরাপত্তা সুবিধা নিলেও সরকারি গাড়ির সুবিধা নেননি। বন্ধুর পুরোনো মডেলের সাদা রঙের একটি গাড়িতেই ইসি ছাড়েন। কাজী হাবিবুল আউয়ালের ইসি ছাড়ার পরপরই নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান ইসি ছাড়েন। তবে জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান সন্ধ্যার দিকে সবার সঙ্গে দেখা করে ইসি ত্যাগ করেন।

পদত্যাগ করা সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছিলেন হাবিবুল আউয়াল

লিখিত বক্তব্যে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার মতো কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না। সে কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন, কী কারণে, কত দিনের জন্য স্থগিত করা যাবে, তাও সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনোই কোনো কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেনি। সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে; দলের মধ্যে নয়। ২৯৯ আসনে এক হাজার ৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।

সিইসি জানান, নির্বাচন নিষ্পন্ন করা অতিশয় কঠিন একটি কর্মযজ্ঞ। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ বা দায়দায়িত্ব সবসময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে; কিন্তু সবসময় সব কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালোটাকা ও পেশীশক্তি-বিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচনী পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।

চার বা আট পর্বে নির্বাচনের পরামর্শ দিয়ে গেছেন সাবেক সিইসি

সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, জনগোষ্ঠীর সমরূপতার কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে তিন থেকে পাঁচ দিনের বিরতি রেখে, অনুষ্ঠান করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে উত্তম হবে। প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।

২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না

অতীত নির্বাচনের ইতিহাস তুলে ধরে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে। সে সবের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৯১-এর নির্বাচন রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, সূক্ষ্ম কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনে বিএনপি সংসদে ২৭টি এবং আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান বা সেফ এক্সিট বিষয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনা সমর্থিত বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দরকষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধান মতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে আসন পেয়েছিল মাত্র ছয়টি, পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি; মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।’

পদত্যাগ করতে চাননি দুই নির্বাচন কমিশনার

গত ৩ সেপ্টেম্বর আগামী সপ্তাহের মধ্যে নিজ নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করবেন বলে প্রতিবেদন করে ঢাকা পোস্ট। তিন নির্বাচন কমিশনার আগেভাগেই পদত্যাগ করতে চাইলেও দুইজন কমিশনার সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সিইসিসহ চার কমিশনার একসাথে বসে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়।

পদত্যাগের আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সময় চান প্রধান নির্বাচন কমিশনার। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে সময়ও দেওয়া হয় সিইসিকে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে কোনো কিছু না জানিয়েই সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনারদের সাক্ষাতের সময় বাতিল করা হয়। এরপরই সিইসি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘বিপ্লব ও ফরমান: সরকার ও সংবিধান’ নামক নিবন্ধন লেখেন। সিইসি ওই নিবন্ধনে উল্লেখ করেন, ‘আলোচনার জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না’। তার মানে করণীয় ঠিক করতে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ না পেয়েই সিইসি ওই নিবন্ধন লেখেন বলে জানান ইসি কর্মকর্তারা।

ওইসময় বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্রে জানা যায়, সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ আরও দুই কমিশনার পদত্যাগ করতে চাননি। কিন্তু বাকি দুইজন কমিশনার সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে মতামত দিয়েছিলেন। সিইসি, নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ও মো. আনিছুর রহমান পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর ও বেগম রাশেদা সুলতানা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে চেয়েছিলেন।

মানসম্মান নিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে চলে যান

গত ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও চার নির্বাচন কমিশনারের স্বেচ্ছায় পদত্যাগের পর সেদিনই তাদের পত্র গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এর আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন টেলিফোনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ চার নির্বাচন কমিশনারকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সিইসিকে রাষ্ট্রপতি পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, মানসম্মান নিয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে চলে যান।  

বিদায় বেলায় জুতা নিক্ষেপ দুই কমিশনারের গাড়িতে

বিদায় বেলায় দুই নির্বাচন কমিশনারের গাড়িতে জুতা নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। পদত্যাগ করে কমিশনারদের জন্য বরাদ্দ করা গাড়িতে ইসি ছাড়ার সময় বাইরের বিক্ষুব্ধ জনতা নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশিদা সুলতানা ও মো. আনিছুর রহমানের গাড়িতে জুতা নিক্ষেপ করে। সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের ঘোষণা উপস্থিত না থাকলেও নির্বাচন ভবনে এসেছিলেন রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান। নির্বাচন ভবন ছেড়ে যাওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ জনতার সামনে পড়েন এই দুই কমিশনার। এরপরে বিক্ষুব্ধ জনতা জুতা খুলে এই দুই কমিশনারের গাড়িতে ছুড়ে মারেন।

পদত্যাগের বিষয়ে আইনে যা বলা হয়েছে

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর ৩ দফায় নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদকাল সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে কোনো নির্বাচন কমিশনারের পদের মেয়াদ তার কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বছর হয়ে থাকে। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ সম্পর্কে একই (১১৮) অনুচ্ছেদের দফা ৫-এ বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারেন, সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হবেন না।

উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণ সম্পর্কে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬-এর দফা ২-এ বলা হয়েছে, প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না।

নির্বাচন কমিশনারদের পদত্যাগ সম্পর্কে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮-এর দফা (৬)-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদ ত্যাগ করিতে পারিবেন। এর আগে ১৯৯০, ১৯৯৬ এবং ২০০৬ সালে আন্দোলন-অস্থিরতার মধ্যে সরকার পরিবর্তনের পর প্রথমেই নির্বাচন কমিশনারদের পদত্যাগ করতে হয়েছিল।’

উল্লেখ্য, প্রথমবারের মতো সিইসি ও ইসি নিয়োগে আইন প্রণয়নের পর সার্চ কমিটির মাধ্যমে ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়ে দায়িত্ব দেন তারা। এই সার্চ কমিটি গঠন নিয়েও তৎকালীন সরকারবিরোধী দলগুলো ব্যাপক আপত্তি তোলে। একতরফা সরকার এ কমিশন গঠন করলেও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনকে এক মুহূর্তের জন্যও মেনে নেয়নি। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক সংস্কারের কথা বলা হলেও নতুন করে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ কতদিনের মধ্যে দেওয়া হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

এসআর/এসকেডি