বিগত সরকারের আমলে সামরিক কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত ও তাদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়ে বঞ্চিত সামরিক কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানানো হয়েছে।

শনিবার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর মহাখালীর রাওয়া কনভেনশন হলের ঈগল হলে বৈষম্যমুক্ত সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশ ২.০ বিনির্মাণে প্রয়োজনীয় রুপরেখা শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান তারা।

সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর সাবেক বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয় হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলম উপস্থিত ছিলেন।

বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত ও বৈষম্যের মাধ্যমে নিপীড়িত এসব কর্মকর্তাদের অন্য দাবিগুলো হলো- বঞ্চিত অফিসারদের পুনর্বাসন এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান। এছাড়া সামরিক বাহিনীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে কমিশন গঠন করে সামরিক আইনের সংস্কারের দাবি জানান তারা।

সংবাদ সম্মেলনে নৌবাহিনীর সাবেক কমান্ডার নেসার আহমেদ জুলিয়াস বলেন, আমরা সবসময়ই সশস্ত্র বাহিনীকে দেশের আদর্শ মনে করি। আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেশ গঠনে এবং বিভিন্ন সময়ে জাতীয় নিরাপত্তা ও দুর্যোগ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। তবে, দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে সশস্ত্র বাহিনীর নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব বারবার বিঘ্নিত হয়েছে। এর ফলে আমরা দেখেছি কীভাবে সামরিক আইন ও নিয়মের অপব্যবহার হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, গুম ও খুন করা হয়েছে এবং বাহিনীর মেধাবী কর্মকর্তাদের অযৌক্তিকভাবে সামরিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত করে বিনা পেনশনে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের এই গৌরবময় প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৈষম্যের ক্ষতিকর ঘুনপোকা প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে এবং ধ্বংস করেছে বাহিনীর প্রশাসনিক অবকাঠামো। এই ঘুনপোকা শুধু কর্মকর্তাদের ক্যারিয়ার নষ্ট করেনি, নষ্ট করেছে জাতীয় নিরাপত্তা এবং সামরিক পেশাদারিত্ব।

তিনি বলেন, সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চর্চা বন্ধ করা এবং তাদের নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা অবিচারের শিকার হয়েছেন, তাদের প্রতি সম্মান ও ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রথমে আমাদের অবশ্যই বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের প্রতি সংঘটিত অন্যায়কে স্বীকার করতে হবে। এই অন্যায়ের স্বীকৃতি দেওয়াই হবে পুনরুদ্ধারের প্রথম পদক্ষেপ।

সরকারের উচিত অনতিবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করা, যার মাধ্যমে নির্যাতিত কর্মকর্তাদের বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করে ন্যায়বিচার প্রদান করা হবে। তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে তারা যেন দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে অবদান রাখতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

এছাড়া নির্যাতিত কর্মকর্তাদের জন্য একটি আর্থিক পুনর্বাসন প্যাকেজ তৈরি করা, যার মাধ্যমে তারা তাদের পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন। বৈষম্যের শিকার হওয়া কর্মকর্তাদের সমুদয় পেনশন ফেরত দেওয়া এবং যাদের চাকরির বয়স রয়েছে তাদেরকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা। সবশেষে একটি নিরপেক্ষ সংস্কার কমিশন গঠন করে বিদ্যমান সামরিক আইনে মানবাধিকারসহ অন্যান্য সাংঘরষিক আইনের পরিবর্তন করা, যেন আর কোনো সরকার সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে না পারে।

তিনি আরও বলেন, গত ৫ সেপ্টেম্বর আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে আবেদন করেছিলাম, আমাদের বিষয়টি আমলে নেওয়ার জন্য। রাষ্ট্রীয় বাসভবনের সামনে সকালবেলা জনগণ রাস্তায় শুয়ে পড়লে বিকেল বেলায় কমিশন হয়ে যাচ্ছে যাচাই-বাছাই এর জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, অদ্যাবধি আমরা উনার কাছ থেকে বা বাহিনী প্রধানদের কাছ থেকে কোনোরকম সাড়া পাইনি। ৫ আগস্ট এ স্বাধীনতার পরে যত দুর্নীতিবাজ তারকাচিহ্নিত অফিসারের কীর্তি জাতির সামনে উন্মচিত হয়েছে এখানের ২০০ জন অফিসারের অপরাধকে একসাথে করলেও তার ১০০ ভাগের ১ ভাগ হবে নাহ।

আজ এক মাস পরে আবারো আমরা প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, আমরা দেশপ্রেমিক সামরিক সদস্য। আমাদের কথাগুলো শুনুন, কীভাবে নির্বিচারে আঙুলের বদলে হাত কাটা হয়েছে, হাত এর বদলে মাথা কাটা হয়েছে। আমরা চাই না আমাদের মতো আর কোনো সামরিক সহকর্মীর অবিচার হোক, গুম-খুন হয়ে যাক, রাজনীতি-সরকার-বৈষম্যের শিকার হয়ে কোনো পরিবার রাস্তায় নামুক।

সংবাদ সম্মেলনে লেফটেন্যান্ট (অব.) সাইফুল্লাহ খান সেনাবাহিনী প্রধানের প্রশংসা করে বলেন, আমরা বিশ্বাস করি আমাদের সেনাবাহিনী প্রধান অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ এবং দয়ালু,  উনি জুনিয়র অফিসারদের মনের ভাষা বুঝেন। সেনাপ্রধান এই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন এবং আমাদের কথা শুনে উনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাসান নাসির বলেন, ‘বিগত ১৫ বছরে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকরিচ্যুত স্বশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে আমরা বৈঠক করি। সবার অভিযোগ আমরা একত্রিত করে আমরা চাকরি ফিরে পাবার দরখাস্ত দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ সেপ্টেম্বর সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সার্ভিস হেডকোয়ার্টারে আমরা আবেদনগুলো জমা দেই। সার্ভিস হেডকোয়ার্টারের ভূমিকায় সন্তুষ্ট না হয়ে ৫ সেপ্টেম্বর আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে এগুলো জমা দেই। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের বঞ্চনার সুরাহা পেলেও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় স্বশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকরা তাদের প্রতি ঘটা অবিচারের সুরাহা পায়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো রিভিউ বোর্ড বা কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন এখন পর্যন্ত করেনি। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা জীবন বাজি রেখে এ দেশের স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকেন।

তিনি বলেন, সশস্ত্রবাহিনীর প্রায় ৪’শর বেশি সদস্য বিগত ১৫ বছরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় ও মতাবলম্বী হওয়ার কারণে তাদের চাকিরচ্যুতি ছাড়াও মানসিক ও শারিরীক নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। এটা শুরু হয় বিডিআর বিদ্রোহের পর থেকে। কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়, এর মধ্যে আমিও একজন।

হাসান নাসির আরো বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা হত্যা তৎকালীন পুলিশ, র‍্যাব, এনএসআই এবং ডিজিএফআইয়ের কতিপয় কর্মকর্তাদের মদদ ছাড়া সম্ভব নয়। একইভাবে ৫ মে শাপলা হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সময়ে ঘটা গুম-খুনের ঘটনায় তৎকালীন সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব ছিল না। তারেক সিদ্দিকি ও জিয়াউল আহসানের পাশাপাশি অনেক সেনা কর্মকর্তা এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত।

এমএম/পিএইচ