বয়সের ভারে ন্যুব্জ শরীর। তার সঙ্গে ৭০ বছর বয়সী শরীরে বেঁধেছে নানা রোগ-বালাই। হঠাৎ ক্ষমতা হারিয়ে বিপর্যস্ত চট্টগ্রাম-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) এবিএম ফজলে করিম। এখন গ্রেপ্তার হয়ে একেবারেই ভেঙে পড়েছেন তিনি।

আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে দুই দিন গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে বেশি প্রশ্ন করতে পারেননি পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশ হেফাজতে তার কোনো দুর্ঘটনা হতে পারে এই আশঙ্কায় সতর্ক ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। তবু যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই উত্তর দেননি তিনি। একেবারেই বিমর্ষ ছিলেন তিনি।

রাউজানের প্রতাপশালী এমপি ছিলেন ফজলে করিম। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০০১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা সংসদ সদস্য তিনি। তবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে। এসময়ে রাউজানে তার কথাই শেষ কথা ছিল। কেউ তার ওপর কথা বলার সুযোগ ছিল না। ওই এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) প্রত্যেক সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের তার অনুগত থাকতে হতো। ফজলে করিমের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না কারও। সবশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে রাউজানের কোথাও কোনো মেম্বার পদপ্রার্থীকে পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেননি ফজলে করিম। যাকে ফজলে করিম মনোনয়ন দিয়েছেন তিনিই একক প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হয়েছেন।

স্থানীয়দের মতে, রাউজানের স্বৈরাচার ফজলে করিম অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শাসন করতেন জনগণকে। এলাকার জমি দখল ও বেচা-বিক্রি সবই হতো তার নিয়ন্ত্রণে। সাংবাদিকসহ নানা পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর ছিলেন তিনি।

জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, রাউজানে দায়িত্বপালনকারী অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ফজলে করিমের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। এ কারণে তার বিষয়ে একটু বেশিই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে। তাকে আদালতে আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে রিমান্ডে পুলিশ হেফাজতে রাখা পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাও ছিল। পাশাপাশি আদালতেও যাতে তার ওপর হামলা না হয় সেজন্য গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কয়েক স্তরে মোতায়েন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আবার প্রচলিত সময়ে তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। একটু আগে করে হাজির করা হয়, যাতে লোকজন বুঝতে না পারে।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রাউজানে নানা বিষয় নিয়ন্ত্রণে রাখা নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পাশাপাশি জনগণকে নির্যাতন করা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। তবে এ ধরনের বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর দেননি ফজলে করিম। ক্ষমতা হারিয়ে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে তার চেহারা একেবারে ভেঙে পড়েছিল। রাজ্যের চিন্তা আর রোগ-শোকে একেবারেই ক্লান্ত দেখা গেছে তাকে। এ কারণে শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় তাকে একেবারে কঠিন প্রশ্ন বেশি করা হয়নি। 

>> রিমান্ডে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ফজলে করিমের বাড়ি থেকে অস্ত্র উদ্ধার 

মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ও পরদিন (বুধবার) রিমান্ডে ছিলেন ফজলে করিম। এসময় তাকে অস্ত্রের ভাণ্ডার নিয়ে নানা প্রশ্ন করে ডিবি কর্মকর্তারা। পরে তার দেওয়া তথ্যে বুধবার সকালে রাউজান উপজেলার গহিরায় অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ। এসময় ফজলে করিম চৌধুরীর বাড়ির আলমারিতে থাকা একটি পয়েন্ট ২২ বোরের রাইফেল, একটি এলজি, একটি রিভলভার, একটি শটগান ও সাত রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে শুধু রাইফেলটির লাইসেন্স ছিল। এ ঘটনায় নতুন করে রাউজান থানায় অস্ত্র আইনে মামলা হয়।

এছাড়া বুধবার দুপুরে ফজলে করিম চৌধুরীর নগরের খুলশী এলাকার একটি ফ্ল্যাটেও অভিযান চালানো হয়। কিন্তু সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি।

>> আদালতে হাজির করা হলেও গাড়ি থেকে নামানো হয়নি ফজলে করিমকে

এদিকে রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম আদালতে হাজির করা হয় সাবেক এমপি ফজলে করিমকে। নিয়মানুযায়ী গাড়ি থেকে নামিয়ে তাকে আদালতের হাজতে রাখার কথা ছিল। কিন্তু গোয়েন্দা তথ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে ফজলে করিমকে গাড়ি থেকে নামাননি পুলিশ কর্মকর্তারা। গাড়িতে রেখেই তাকে হাজির করা হয়েছে বলে আদালতকে অবহিত করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পরে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল হারুনের আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার পরিদর্শক জাকির হোসাইন মাহমুদ বলেন, কঠোর নিরাপত্তায় ফজলে করিমকে আদালতে আনা হয়েছিল। আদালতের আদেশ মূলে তাকে কারাগারে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়। এরপর গত ১২ সেপ্টেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের আবদুল্লাহপুর এলাকা থেকে ফজলে করিমসহ তিনজনকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ফজলে করিম আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলে বিজিবি জানিয়েছে।

ঘটনার পর বিজিবি জানিয়েছে, আটক বাকি দুজন হলেন আখাউড়ার নূরপুর এলাকার সাবেক মেম্বার মো. হান্নান মোল্লা এবং আখাউড়ার স্থানীয় বাসিন্দা মো. নাঈম চৌধুরী। পরে তিনজনের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলা হয়। সেই মামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে ছিলেন ফজলে করিম। গত ১৯ সেপ্টেম্বর তাকে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম আনা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর চট্টগ্রামে ফজলে করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে।

এমআর/এসএম