অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠক নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউস। বিবৃতিতে বাংলাদেশের নতুন সংস্কার কর্মসূচিতে মার্কিন সমর্থন অব্যাহত রাখার কথা জানানো হয়েছে। 

এছাড়া, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং বাংলাদেশে তাদের আশ্রয়দানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে প্রায় ২০ কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ২. ইউনূস এখন যুক্তরাষ্ট্রে এবং সেখানেই বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাতে বাইডেনের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেন।

এছাড়া, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভার সঙ্গে বৈঠক ছাড়াও সাক্ষাৎ হয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফসহ বেশ কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে।

আগামীকাল শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ড. ইউনূসের ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে।

ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের মঞ্চেও বক্তব্য দিয়েছেন ড. ইউনূস। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নিজেও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

জাতিসংঘে ড. ইউনূসের বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিমার ছবিতে সয়লাব হয়ে গেছে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের জাতিসংঘে উপস্থিতির পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো যে উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা থেকে বাংলাদেশও যেমন সহযোগিতার বার্তা পেয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা পেয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছর ধরে গণতন্ত্র ও নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপড়েন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল। এই টানাপড়েনের দৃশ্যমান সূচনা হয়েছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এলিট ফোর্স র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে।

পরে ২০২৩ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন সামনে রেখে ভিসানীতি ঘোষণা করে, যা তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে নজিরবিহীন চাপে ফেলে দিয়েছিল।

ওই সময় শেখ হাসিনা নিজে ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বাংলাদেশের সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ বা ওই এলাকায় সামরিক ঘাঁটি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, এমন বক্তব্যও তারা দিয়েছেন, যা যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।

এরপরেও গত জানুয়ারিতে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও গত মে মাসে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা এবং দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণ দেখিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিলে চাঞ্চল্য তৈরি হয়।

যদিও নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার কথা বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতেও আস্থা কিংবা উষ্ণতার ঘাটতি অনেকের কাছে দৃশ্যমান ছিল।

এমন পরিস্থিতিতে গত জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, যা পরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। তার পদত্যাগের পর ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিলে পশ্চিমারা তাকে স্বাগত জানায়।

যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূসকে জো বাইডেনসহ পশ্চিমা নেতারা যেভাবে স্বাগত জানিয়েছেন, তাতে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অধ্যাপক ইউনূসের যে গ্রহণযোগ্যতা, তাতে এ ধরনের অভ্যর্থনাই তার জন্য স্বাভাবিক। প্রভাবশালী রাষ্ট্র নেতারা যেভাবে তাকে গ্রহণ করেছেন, তাতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও বেড়েছে।

তবে, র‍্যাবের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে নতুন করে আলোচনা বা অগ্রগতি হয়নি।

গণতন্ত্র বা মানবাধিকার ইস্যুতে উন্নয়নের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো সময় দিচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

গত ৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেছিলেন, বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত ও আগ্রহী।

কী বার্তা আছে বাংলাদেশের জন্য?

বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনূসের সরকারপ্রধান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এবারের সফরে বাংলাদেশ তার সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও গণতন্ত্রের উত্তরণের জন্য বৈশ্বিক সমর্থনের বার্তা পেয়েছে। তারা মনে করেন, এ কারণে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব সংস্থা এখন বাংলাদেশের দিকে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, বাংলাদেশে যে

একটি নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বা দেশটি যে নতুন দিকে যাচ্ছে, সেই বার্তাই ড. ইউনূসের মাধ্যমে বাইরের পৃথিবীতে গেল।

 

তিনি বলেন, তাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রে যা হয়েছে তাতে বিশ্ব বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক বার্তা পেয়েছে। এখন বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়ায় এগোতে চাইছে, তা নিয়ে বিশ্ব বুঝতে চেষ্টা করবে। আবার বাংলাদেশও এটি জেনেছে যে, তারা নিজেদের সংস্কার কার্যক্রমে বৈশ্বিক সমর্থন পাবে।

প্রসঙ্গত, ড. ইউনূস সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন, সংবিধান, বিচার বিভাগসহ কয়েকটি খাতের জন্য মোট ছয়টি কমিশন গঠন করেছেন। যেগুলো আগামী অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করবে এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই তার বা সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করবে।

ড. কবির বলছেন, এই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা ছাড়াও সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও জাতিসংঘের নানা সংস্থার টেকনিক্যাল সহায়তা দরকার হতে পারে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল সাপোর্টের জন্যও। আবার বিশ্বের আরও অনেক দেশের একই ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। তাদের ভালো অভিজ্ঞতাগুলোও বাংলাদেশ এখন জানতে পারবে।

হুমায়ুন কবির বলছেন, বাংলাদেশের জন্য বার্তাটা পরিষ্কার যে, নতুন প্রেক্ষাপটে বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এখন তারা যাতে সহযোগিতা করতে পারে, সেই ক্ষেত্র বাংলাদেশকে প্রস্তুত করতে হবে। ড. ইউনূস এমনি বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত। এখন তিনি সরকারপ্রধান। এটার একটা সুবিধা যে বাংলাদেশ পাবে, তারও ইঙ্গিত আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূস যে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন, সেটিই স্বাভাবিক।
কারণ ওনার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা। এ কারণেই সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের সংস্কারের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা সঙ্গে থাকার শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য খুবই দরকার ছিল। 

এছাড়া, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে, সেটি কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশের নাম এখন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইতিবাচকভাবে আসবে বলে মনে করছেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

কেএ