সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসামরিক, শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র করে ৮ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে দুদক উপপরিচালক ও অনুসন্ধান টিম প্রধান মো. মনজুর আলম ওই তলবি চিঠি দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণপূর্বক আত্মসাতসহ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

তলবি চিঠিতে সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও ডাচ বাংলা ব্যাংক পিএলসির বিভিন্ন শাখা বরাবর পাঠানো হয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানের স্বার্থে ব্যাংকগুলোর লোকাল শাখাসহ অন্যান্য শাখায় সালমান এফ রহমান ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রদত্ত ব্যক্তিগত ঋণ এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদত্ত বা বরাদ্দকৃত মোট ঋণের পরিমাণ, এ ঋণের বিপরীতে রক্ষিত জামানত, ঋণ আবেদন-প্রস্তাব-অনুমোদন ও ঋণ বিতরণ, সুকুক বন্ডের বিপরীতে প্রদত্ত ঋণসহ বরাদ্দকৃত এবং বিতরণকৃত সব ঋণ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র তলব করা হয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওইসব নথিপত্র পাঠানোর অনুরোধ করেছে দুদক।

ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগে বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে গত ২২ আগস্ট অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসামরিক, শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও অন্যান্যের বিরুদ্ধে শেয়ার বাজারে জালিয়াতি, প্লেসমেন্ট শেয়ার কারসাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার হোল্ডারদের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণপূর্বক আত্মসাতসহ হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন সালমান এফ রহমান। দরবেশখ্যাত এই ব্যক্তির নামে গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার পাশাপাশি পণ্য রপ্তানি করে দেশে টাকা না আনার অভিযোগও রয়েছে তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে।

এভাবে নানা অনিয়ম করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন সালমান এফ রহমান। তিনি কত টাকার মালিক তার প্রকৃত হিসাব কারো কাছে নেই। ২০০৬-২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঋণখেলাপিসহ নানা অভিযোগে জেলে গিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। এরপর জেল থেকে বের হয়ে নাম জড়ান ২০১০-১১ সালের শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে। এতকিছুর পরও তাকে স্পর্শ করার সাহস হয়নি কারও।

গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে। ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে তার প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটি ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। পণ্য রপ্তানি করে সেই অর্থ দেশে না আনার অভিযোগও রয়েছে তার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, গত ৩১ বছরে শেয়ারবাজারের প্রত্যেকটি বড় কেলেঙ্কারিতে সালমান এফ রহমান জড়িত। গত ৩ বছরে তিনি দৃশ্যমানভাবেই বাজার থেকে নিয়েছেন ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর অদৃশ্যভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন ২০ হাজার কোটি টাকা।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সালমান এফ রহমান। শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবসায়ী নেতার পর ২০১৮ সালে এমপি ও টানা দুইবার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন তিনি। হাজারো ব্যবসায়ীকে পথে বসানো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির এক অবিচ্ছেদ্য নাম সালমান এফ রহমান।

২০১০-১১ সালে শেয়ার বাজার ধসের পর এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান ছিলেন খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। সেই রিপোর্টে পুঁজিবাজারে ফিক্সড প্রাইস, বুক-বিল্ডিং, রাইট শেয়ার, ডিরেক্ট লিস্টিং, সম্পদ পুনর্মূল্যায়ন, প্রেফারেন্স শেয়ারসহ সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম হওয়ার এবং এর সঙ্গে সালমান এফ রহমানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তাই খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সেই রিপোর্টে সালমান এফ রহমান থেকে পুজিবাজারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

এ ছাড়া, সালমান এফ রহমান বিভিন্ন কোম্পানির প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও প্রমাণ পায় সেই কমিটি। অথচ এসব অনিয়মের সঙ্গে সালমান এফ রহমানসহ আরও কয়েকজনের নামে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

২০০৬-০৭ সালের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতিবিরোধী একটি টাস্কফোর্স করা হয়েছিল। টাস্কফোর্স বিভিন্ন দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য বের করেন যে, ১২২ জন রাজনৈতিক নেতা ও আমলা দুর্নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে ৪৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ মোট ১৭টি দেশে এসব অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচার হওয়া ৪৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এক হাজার কোটি টাকা সালমান এফ রহমানের। আমেরিকায় রিয়েল এস্টেট ব্যবসার নামে এসব টাকা পাচার করা হয়েছিল।

আরএম/এমজে