ডিবি অফিসে নির্যাতনের বর্ণনা
হাত-পা ও চোখ বেঁধে ঝুলিয়ে পেটানো হয় : আবু বাকের
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ডিবি অফিসে হেফাজতে থাকাবস্থায় দ্বিতীয় দিন নির্মম নির্যাতন করা হয় সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদারের ওপর। ফেসবুকে সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, টর্চার সেলে তাকে চোখ ও হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে বেধড়ক পেটানো হয়। পানি চাইলে বোতলের ছিপিতে করে দেওয়া হয়।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি ডিবি অফিসে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার বর্ণনা দেন।
বিজ্ঞাপন
বর্ণনার শুরুতে আবু বাকের বলেন, ডিবি হেফাজতের দ্বিতীয় দিন আমাকে, নাহিদ ভাইকে এবং আসিফ ভাইকে হারুনের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। হারুনের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত বাজে এবং হল ছাত্রলীগের উপ-সম্পাদক ক্যাটাগরির। আমাদেরকে বলছিল, আমি নেতা ছোট করি, নেতা বানাই না। দেখোস নাই, নুরুরে কী করে ছেড়ে দিছি! নুরু এখন রিমান্ডে কান্নাকাটি করে।
আরও পড়ুন
তিনি যেভাবেই কথা বলুক না কেন, আমরা তিনজন খুব দৃঢ়ভাবে কথা বলে যাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে বলেন, তুই শিবির! আমি বলি, না আমি শিবির না! তিনি আবারো (একটু উচ্চ শব্দে) বলে, না, তুই শিবির। আমি আবারো বলি না (তার থেকে উচ্চ শব্দে)। তিনি আসিফ ভাই, নাহিদ ভাইকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, দেখ সে কিভাবে কথা বলে! আমি বলতে থাকি, আমার পুরো বাড়ির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, আমার বাড়িতে যোদ্ধারা ক্যাম্প করেছিলো, আমি সেই বৃহত্তর পরিবারের সন্তান।
ডিবি হারুনের সঙ্গে উচ্চবাচ্য করায় তাদেরকে টর্চার সেলের দিকে নেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, আমি তার থেকে উচ্চবাচ্য করায় সে খাবারের প্লেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে এক অফিসারকে ইশারা দিয়ে বলে আমাদেরকে নিয়ে যেতে। আমাদের তিনজনকে তিনটি আলাদা রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। রুমে যাওয়ার ৩-৪ মিনিট পর দুজন লোক এসে আমাকে দরজায় আসতে বলে, তাদের হাতে ছিলো জম টুপি (কালো বড় টুপি, গলা পর্যন্ত ঢেকে যায়) এবং হাতকড়া। বুঝে গেছিলাম খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে।
দরজায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই টুপি পরায়, তারপর হাতকড়া পরায়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, দুনিয়ার আলো কিছুই দেখা যায় না, ভয়ংকর একটা পরিবেশ। ডানে, বামে ঘুরিয়ে হাঁটানো শুরু করলো, বারবার মনে হচ্ছিলো ছাদের পাশে নিয়ে এই অবস্থায় ফেলে দেয় কিনা! আর জিজ্ঞেস করতেছিলাম, নাহিদ ভাই, আসিফ ভাইকেও নিচ্ছে কিনা? তারা জানালেন, তারা এ বিষয়ে জানে না, উনাদের দায়িত্ব শুধু আমাকে নিয়ে যাওয়া। নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই অনেক অসুস্থ ছিলেন, উনাদের জন্য ভয় হচ্ছিলো।
আরও পড়ুন
চোখ, হাত বেঁধে, এক পায়ে দাঁড় করিয়ে প্রথম দফায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয় জানিয়ে তিনি বলেন, যাই হোক, তারপর লিফটে, আবার হেঁটে, আবার সিঁড়িতে, এভাবে কোনো একটা রুমে নিয়ে গেলো। একটা জিনিস বারবার মাথায় আসছিলো যে আমাকে মেরে ফেলে কি না, ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছে তো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সাধারণ ঘটনা ছিলো। তারপর রুমে নিয়ে দেওয়ালের দিকে ঘুরিয়ে জম টুপি খুলে গামছা দিয়ে খুব শক্ত করে চোখ বাঁধলো, আর হাতগুলোও বড় গামছা দিয়ে বাঁধলো। হাত বাঁধার সময় এমনভাবে বাঁধলো যেন হাতের বেশি জায়গা জুড়ে গামছা থাকে। তারপর উলটা ঘুরতে বলে, একপায়ে দাঁড়াতে বলে। টানা ৭২ ঘণ্টা না ঘুমানোয় শরীরে ব্যালেন্স ছিলো না। দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হই। শেষে সোজা হয়েই দাঁড়াতে বলে এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
তিনি বলেন, ওদের কথায় বুঝতে পারছিলাম যে, ওরা মোটামুটি আমাদের সবকিছু জানে। আমাকে শুরুতেই বলে, তুই তো জুনের ৯ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশকে সংগঠিত করতে লিড দিছস, তোর তো আন্দোলনকে বড় করার অনেক খায়েশ! তোরে এগুলো কে শিখাইছে? তোর ত বয়স বেশি না! ট্রেনিং পাইছোস কই? উত্তরে আমি বলি, আমি ছাত্র-সংগঠন করি, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য সচিব, সংগঠন শুরুতে দাড় করানোর জন্য এবং পরবর্তীতে বিস্তারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমি মানুষকে সংগঠিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি।
১৫ জুলাই ঢাবিতে মারামারির প্রসঙ্গ টেনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারপর আবার, তুই ফ্রন্টলাইনে আসিস না কেন? তুই কি মনে করিস তোরে আমরা চিনি না? তুই কোথায় কি করিস সব তথ্য আছে। আমি চুপ থাকি, পরে আবার বলে কথা বলিস না কেন? আমি বলি, আমি ব্যাকস্টেজে কাজ করতে পছন্দ করি।
আবার বলে, ১৫ তারিখ একাত্তর হলে যখন মারামারি হয় তখন তুই কই ছিলি? আমি বলি, একাত্তর হলের সামনেই। তারা বলে, তুই তো প্রথম মারামারি লাগাইছস, মারামারিতে নেতৃত্ব দিছস! আমি বলি, ছাত্রলীগ আমাদের মারে, পরে আমরা প্রতিরোধ করি। এভাবে অনেক প্রশ্ন-উত্তর হয় ১৫ জুলাই নিয়ে।
তারপর জিজ্ঞেস করে, তোর গুরু কে? উত্তর দিই আমার কোনো গুরু নাই, শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থে সংগঠন করি, আর আন্দোলনও ঠিক একই কারণে করে যাচ্ছি। এই বিষয়েও আরো অনেক সাবস্টিটিউট প্রশ্ন উত্তর হয়। তারপর আবার, তুই কি সরকারি চাকরি করবি? আমি বলি করতেও পারি, তবে আমার রাজনীতি ও একাডেমী নিয়ে আগ্রহ আছে। এটা নিয়ে অনেক প্যাচানোর চেষ্টা করে।
এরপর পাশের রুমে নিয়ে ঝুলিয়ে পেটানো শুরু হয় জানিয়ে আবু বাকের মজুমদার বলেন, এরকম আরও অসংখ্য প্রশ্ন করে। তারা বলে, সরকার তো কোটা নিয়ে সব দাবিদাওয়া মেনে নিয়েছে তারপরও এখন কিসের আন্দোলন? আমি চুপ থাকি, ওরা চিৎকার করে, তখনো চুপ থাকি। একজন বলে, ওরে ঝুলা। আমি তখনো চুপ থাকি। তারপর পাশের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, নিয়ে হাত উপরে ঝুলিয়ে বাঁধা হয়। আমি বলি পিঠে মারলে মরে যাবো, বাম পায়ে একটু সমস্যা আছে, বাম পাটা ভেঙে যাবে। ওরা কিছু বলে না।
একের পর এক আঘাত শরীরে পড়তে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, এক পর্যায়ে নিতম্বে মোটা শক্ত কোনো লাঠি দিয়ে একের পর এক আঘাত করে, আর আমি চিৎকার দিয়ে উঠি। আর ওরা বলে, প্রাইমিনিস্টারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিবৃতি দিবি? আমি বলি- না। এরকমভাবেই চলতে থাকে। স্কুল লাইফে টিচারদের অনেক মাইর খেয়েছিলাম, স্যাররা বেত ব্যবহার করতেন, মারার সময় নার্ভ সিস্টেম অটোমেটিক একটা প্রটেক্টিভ ভূমিকায় চলে যেত, অন্তত মেন্টাল প্রিপারেশন থাকত। কিন্তু এখানে তা নাই, চোখ বন্ধ, হাত বাঁধা, যেন হুট করে লাঠির আঘাত লাগছে।
পানি চাইলেও বোতলের ছিপিতে পানি দিতো জানিয়ে তিনি বলেন, খুব ভয়ংকর লাগছিলো এবং ব্যথা তুলনামূলক বেশি পাচ্ছিলাম। আমি পানি চাই, বোতলের ছিপি করে এক ছিপি পরিমাণ পানি দিয়েছিলো। জিহ্বা-গলা শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে গিয়েছিলো। বেধড়ক মারার পর এক পর্যায়ে সামনে থেকে কেউ একজন বলে, ওরে রেস্ট দে। বড় নিঃশ্বাস নিলাম। আর ভাবতেছিলাম, যতো ভয় পাইছি যে সহ্য করতে পারবো কি না, ততো না! আসলে বেঁধে পেটালে কার সহ্য হয়! যাইহোক তারপর দ্বিতীয় দফায় মার খাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
এরপর প্রস্রাবের বেগ পেলে তাকে ঝুলিয়ে রাখা থেকে খুলে দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, উপরে হাত ঝুলানো হলেও পায়ের আঙুল ফ্লোরে লাগিয়ে একটু ভর দেওয়া যাচ্ছিলো। প্রথম দফা মারার পর আমাকে প্রায় এক ঘণ্টা বা তারও বেশি এভাবে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। আর আমি পানি চাইলে বোতলের মুখে (ছিপিতে) পানি দিতো। এভাবেই যাচ্ছিল, আর মনে মনে সেকেন্ড রাউন্ডের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আর ভাবিতেছিলাম, নাহিদ ভাই আর আসিফ ভাইয়ের যেন কী অবস্থা! ওই সময়ে আমি তুলনামূলক উনাদের থেকে স্ট্রং ছিলাম। যাই হোক, এক পর্যায়ে আমার অনেক প্রস্রাবের বেগ হলে তাদেরকে জানালে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।
সুস্থ হিসেবে টর্চার সেলে ঢুকিয়ে নির্যাতন করে অবশ বানিয়ে বের করা হয় জানিয়ে এই সমন্বয়ক বলেন, ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর আমাকে আর ঝুলায়নি, এবার একটা চেয়ারে বসতে দেয়। হাত চোখ বাধা অবস্থায় পড়ে থাকি, আর সেকেন্ড রাউন্ডের অপেক্ষা করি। সেকেন্ড রাউন্ড কখন শুরু হবে, জিজ্ঞেস করলে সামনে থাকা ব্যক্তি বলেন, তিনি জানেন না, তার স্যার উপস্থিত নাই।
নরমাললি ঝুলানো অবস্থা থেকে বসালে ব্যাথা আরো বেড়ে যায়, ঝুলানো থেকে খোলার পর হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায়ে আবার দুজন এসে হাত খুলে দেয় কিন্তু চোখ বাঁধা অবস্থায় থাকে। হাঁটতে গিয়ে দেখি হাঁটা যাচ্ছে না, এক পর্যায়ে ওদের দুই কাঁধের ওপর আমার দুই হাতের ভর দিয়ে অনেক কষ্টে আমাকে যে রুমে রাখা হতো সেই রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার রুমে, যারা ছিলেন, তাদের একজন বলতেছিলো, সুস্থ একটা মানুষকে নিয়ে দেখ কী করে দিছে, এদেরকে আল্লাহ মাফ করবে না।
কেএইচ/এমএসএ