অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ২৪ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক পৌঁছাবেন। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই তার প্রথম বিদেশ সফর। এই সফর ঘিরে নিউ ইয়র্কের গত ১৬ বছরের দৃশ্যপট এবার বদলে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। অপরদিকে বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলদুটির পক্ষ থেকে এমন কর্মসূচি সফল করতে ইতোমধ্যে প্রস্তুতি সভা হয়েছে। 

সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরেই প্রতিবাদ জানাবে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে দেশে স্বাভাবিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাবে। দলটির সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে।

অপরদিকে পাল্টা অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খুন-গুম-নির্যাতন আর লুটপাটের বিচার চাইবে বিএনপি।

যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন ড. ইউনূস। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তির ৫০ বছর উপলক্ষে আগামী মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কে একটি সংবর্ধনার আয়োজন করছে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন। ওই অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দেবেন। এর পাশাপাশি নিউ ইয়র্কে অবস্থানের সময় প্রধান উপদেষ্টার সামাজিক ব্যবসা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র ব্যবসায়ী পরিষদের সভায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।

পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি বিএনপি-আওয়ামী লীগের : ড. ইউনূসের আগমন কেন্দ্র স্বাগত জানাবে বিএনপি। আওয়ামী লীগ করবে প্রতিবাদ। এতদিন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জাতিসংঘে শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে স্বাগত মিছিল-মিটিংসহ বিভিন্ন আয়োজনে ব্যস্ত থাকত আওয়ামী লীগ। আর কালো পতাকা প্রদর্শনসহ বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে শেখ হাসিনার আগমনের প্রতিবাদ জানাত বিএনপি। ভাষণের দিনে জাতিসংঘের সামনে পক্ষে-বিপক্ষে স্লোগানে নিজেদের শক্তির জানান দিত উভয় দল।

তবে এবার সেই আবহ পাল্টে গেছে। ড. ইউনূসের আগমনের বিরুদ্ধে বিমানবন্দরসহ জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচির কথা বলছে আওয়ামী লীগ যুক্তরাষ্ট্র শাখা। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল আমিন বাবু সংবাদ মাধ্যমকে জানান, জাতিসংঘে ড. ইউনূসের আগমন উপলক্ষে বিমানবন্দর থেকে শুরু করে ভাষণের দিন জাতিসংঘের সামনে তারা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করবেন। স্বাভাবিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে নবান্ন পার্টি হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান লিখিত বক্তব্যে বলেন, অসাংবিধানিকভাবে জোরপূর্বক অন্তর্বর্তীকালীন দখলদার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূস দেশে নৈরাজ্য ও পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের জনগণ শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। অনির্বাচিত অবৈধ দখলদার সরকারের দমননীতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণে দেশে আইন বিচার বলে কিছুই নেই। দেশ পরিচালনায় কোনো ধরনের দক্ষতা তার নেই। নিজেই বলেছেন ছাত্ররা তাকে নিয়োগ দিয়েছেন। তাই স্বাভাবিকভাবে জনগণের কাছে তার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অংশগ্রহণ করার যেকোনো মানদণ্ডে আইনগত বৈধতা নেই।

অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টাকে সাংগঠনিকভাবে স্বাগত জানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির এইচ চৌধুরী। তিনি জানান, শেখ হাসিনার আমলে খুন-গুম-নির্যাতনের বিচার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের দিনে জাতিসংঘের সামনে বিএনপি অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খুন-গুম-নির্যাতন আর লুটপাটের বিচার চাইবে বিএনপি।

যুক্তরাষ্ট্র যুবদল নেতা মাসুদ রানা জানান, প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানানোর জন্য নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের কাবাব কিংয়ে প্রস্তুতি সভার আয়োজন করা হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বরের ওই সভায় বিস্তারিত আলোচনা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কর্মসূচির দিন আওয়ামী লীগ কোনো বাধা দিলে প্রতিহত করা হবে।

এদিকে ড. ইউনূসের সঙ্গে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধান সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এ ছাড়া ড. ইউনূসের সঙ্গে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্স হামাদ বিন ইসা আল খালিফা, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক শফ, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েনের সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে।

পাশাপাশি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক সামান্থা পাওয়ার, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মহাপরিচালক গিলবার্ট এফ. হংবোসহ জাতিসংঘের আরও অনেক সংস্থার প্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন বলে জানা গেছে।

বাইডেনের সঙ্গে দেখা হবে ড. ইউনূসের : আয়োজক দেশ হিসেবে নিউ ইয়র্কে বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য সংবর্ধনা দেওয়ার রীতি রয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের। ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি অতিথিদের জন্য একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। সেখানে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের। সেই অনুষ্ঠানে বাইডেনের সঙ্গে দেখা করার পাশাপাশি কথা বলার সুযোগ হবে ড. ইউনূসের।

জাতিসংঘের অধিবেশনের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাধারণত এক থেকে দেড় দিনের জন্য নিউ ইয়র্কে আসেন। সাধারণত ওই সময়ে বিদেশি রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন না। তবে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার সুবাদে যতটা আলাপ করা যায়, সেটি হয়তো করার চেষ্টা করেন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানরা।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে তিনি ২৭ সেপ্টেম্বর বক্তব্য রাখবেন। সফরসঙ্গী হিসেবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ; সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানসহ প্রায় ২০ জনের প্রতিনিধিদল নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন। প্রধান উপদেষ্টা সফর শেষে নিউ ইয়র্ক থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকায় রওনা হওয়ার কথা রয়েছে।

এমএসএ