বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে নাজমুল নামের এক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে অকথ্য নির্যাতনের অভিযোগে চট্টগ্রাম ১৪ পুলিশের নাম উল্লেখ করে থানায় মামলা রেকর্ড হয়েছে। শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) নগরের বাকলিয়া থানায় মামলাটি রেকর্ড হয়। 

শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। 

যদিও মামলাটির বিষয়ে বেশ গোপনীয়তা রক্ষা করতে দেখা গেছে পুলিশ কর্মকর্তাদের। কারণ মামলায় যারা আসামি হয়েছেন, তাদের অনেকেই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে (সিএমপি) কর্মরত রয়েছেন। মামলা রেকর্ডের পর আদালতের আদেশ মোতাবেক এটির তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটির চট্টগ্রামের বিশেষ পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) শাহনেওয়াজ খালেদই এটি তদন্ত করবেন।

এর আগে, বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেনের আদালতে মামলাটি করেন নাজমুল হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর বড় ভাই মো. নজরুল ইসলাম।

মামলার আসামিরা হলেন, চট্টগ্রাম নগর পুলিশ দক্ষিণ জোনের সাবেক উপ-কমিশনার (ডিসি) মোস্তাফিজুর রহমান, কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) অতনু চক্রবর্তী, কোতোয়ালি থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম ওবায়েদুল হক, বাকলিয়া থানার সাবেক ওসি আফতাব উদ্দিন, কোতোয়ালি থানার পেট্রোল ইন্সপেক্টর (ট্রাফিক) মো. মিজানুর রহমান, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মেহেদী হাসান, গৌতম, আবদুস সালাম ও মো. মিজান, এএসআই রুবেল মজুমদার ও রণেশ বড়ুয়া, কনস্টেবল শাহজাহান, কামাল এবং মো. ইলিয়াছ। এছাড়া, আরও কয়েকজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। 

মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, গত ১৮ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বন্ধুদের সঙ্গে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী নাজমুল হোসেন বাকলিয়া থানার নতুন ব্রিজ এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। পুলিশ ছাত্রদের ওপর অতর্কিতভাবে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ এবং রাবার বুলেট ছোড়ে। ঘটনাস্থল থেকে সুস্থ অবস্থায় নাজমুলকে আটক করে শারীরিক আঘাত করতে করতে পুলিশ বক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পুলিশ সদস্যরা লোহার স্টিক, বক্সে থাকা স্ট্যাম্প দিয়ে ভুক্তভোগীকে বেধড়কভাবে সারা শরীরে শিবির বলে পেটাতে থাকেন। 

নাজমুলকে পুলিশের একটি গাড়িতে করে প্রথমে চান্দগাঁও এবং আধঘণ্টা পর কোতোয়ালি থানায় নেওয়া হয়। গাড়ি থেকে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনজন এসআই ও একজন কনস্টেবল ‘শিবির আনা হয়েছে’ এবং ‘আন্দোলন করো মজা বুঝবে’ বলে উল্লাস করে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারতে থাকেন। পরে থানার দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে নিয়ে ‘মজা কী এখনই বুঝবে’ বলে উল্লাস করে নাজমুলের দুই হাত ওপরে তুলে দেওয়ালমুখী করে দাঁড় করিয়ে কাঠের স্ট্যাম্প এবং লাঠি দিয়ে পিঠ, কোমর ও দুই পায়ের উরুতে মারধর করেন। ওই সময় কোতোয়ালি জোনের এসি অতনু চক্রবর্তী এবং থানার সাবেক ওসি ওবায়েদুল হক তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নিয়ে চেক করতে থাকেন। ওসি মোবাইল ফোনে কিছু না পেয়ে নাজমুলকে শিবির করেন কিনা জিজ্ঞেস করেন।

তিনি না সূচক জবাব দিলে বুকে লাথি মেরে ফ্লোরে ফেলে দেন। দু’টি কাঠের স্ট্যাম্প দিয়ে নাজমুলের দুই হাতের দুই বাহুর ওপর রেখে ওই স্ট্যাম্পের ওপর দুইজন করে দাঁড়ান। এ সময় এসি ও ওসি তাকে শিবিরকর্মী বলে স্বীকার করে নিতে জোর করেন। একপর্যায়ে ভুক্তভোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু মেডিকেলে না নিয়ে তাকে আবারও কোতোয়ালি থানায় নেওয়া হয়। ওইদিন বিকেলে বাকলিয়া থানার টহল পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।

এদিকে, নাজমুলের বড় ভাই নজরুল খবর পেয়ে বাকলিয়া থানায় যান। এ সময় ওসির বডিগার্ড কনস্টেবল মো. ইলিয়াছ তাকে বাকলিয়া থানার দ্বিতীয় তলায় দেখে থানায় কেন ঘুরাঘুরি করছেন জানতে চান। তখন তিনি ছোট ভাইয়ের খোঁজে এসেছেন বলায় ওই কনস্টেবল উত্তেজিত হয়ে চিৎকার ও চেঁচামেচি করতে থাকেন। তখন ওই কনস্টেবল বলেন, ‘ওই শালা (নাজমুল) একটা শিবির, শালা আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ওকে মেডিকেলে নেওয়ার আগে এখানেই গুলি করে মেরে ফেলব। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দৌড়ে থানার হাজতখানায় গিয়ে শটগান ভুক্তভোগী নাজমুলের দিকে তাক করে গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখান। 

রাত ১১টার দিকে কলেজছাত্র নাজমুলের অবস্থার অবনতি হলে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা করানো হয়। পরে ১৯ জুলাই চিকিৎসাধীন নাজমুলকে ৮ নম্বর আসামি করে বাকলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। যে মামলায় ১৪ দিন কারাগারে থাকার পর আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দেন।

এমআর/কেএ