গত ৪ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় ও মহানগরীতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ।

সংগঠনটি আরও জানায়, একই সময়ের মধ্যে ৪ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, ৯১৫টি বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, ৯৫৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, বসতবাড়ি দখল ১টি, ৩৮টি শারীরিক নির্যাতন এবং ২১টি জমি/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখলের ঘটনা ঘটেছে।

বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) নসরুল হামিদ মিলনায়তনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত ‘৪ আগস্ট ২০২৪ থেকে ২০ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চালচিত্র উপস্থাপনের নিমিত্তে’ সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরেন পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও।

নির্মল রোজারিও বলেন, বাংলাদেশের দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরে সর্বমোট ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ১ হাজার ৭০৫টি পরিবারের সদস্যরা সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে। এই পরিবারগুলোর মধ্যে ১৫৭টি পরিবার রয়েছে যাদের বসতবাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এছাড়া  সহিংসতার শিকার ১৭ হাজার ৫টি পরিবারের মধ্যে খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে, যেখানে ৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১ জন বাকপ্রতিবন্ধী।

তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার ১৭ হাজার ৫টি পরিবারের মধ্যে ৩৪টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের পরিবার রয়েছে, যাদের বসতবাড়ি লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কয়েকটি পরিবারের জমি জবরদখল করা হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে ৬৯টি উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রতিটি বিভাগেই এ ঘটনা ঘটেছে এবং হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও লোকজন আক্রান্ত হয়েছে।

নির্মল রোজারিও বলেন, সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় প্রায় ৫০ হাজার নর-নারী, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান কিশোর-কিশোরী, শিশু ও প্রতিবন্ধী মানুষ সরাসরি আক্রান্ত আক্রান্ত হয়েছে। সারা দেশে আনুমানিক ২ কোটি ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠী যারা বর্তমানে আতঙ্ক ও ভয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।

১৫৭টি পরিবার রয়েছে যারা বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অর্থ-সম্পদ সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পরিবারপরিজন নিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

এ সময় দেশের বিভাগগুলোতে সহিংসতার ঘটনাও তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, দেশের বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে খুলনা বিভাগে ৮১০টি। রাজশাহী বিভাগে ২৯৭টি, রংপুর বিভাগে ২৭১টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২২৪টি, ঢাকা বিভাগে ১৬০টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০০টি, বরিশাল বিভাগে ৮৬টি ও সিলেট বিভাগে ৬২টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

নির্মল রোজারিও বলেন, শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে, যা এর পরেও অব্যাহত থাকে। এখনও রয়েছে। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে টার্গেট করে সমাজের এক শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানী দুর্বৃত্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, উপাসনালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। জোরপূর্বক জায়গা-জমি দখল করা হয়েছে, হচ্ছে। কোথাও কোথাও নারীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। চাঁদাবাজি করা হয়েছে, হচ্ছে নয়তোবা দেশত্যাগের হুমকিও দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে।

এ সময় সংবাদ সম্মেলন থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবতাবিরোধী সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনাবলীর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করা হয়। ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তসহ সংগঠনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অবসান, দোষীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ।

এ সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব রক্ষায়  ৮ দফা জানানো হয়। তাদের দাবিগুলো হলো:

সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা; জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন করা; অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ প্রয়োগে যাবতীয় আমলাতান্ত্রিক বাধা অপসারণ করে ট্রাইব্যুনালের রায়ের আলোকে জমির মালিকানা ও দখল ভুক্তভোগীদের বরাবরে অনতিবিলম্বে প্রত্যর্পণ করা; জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারে, সংসদে, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সকল সংস্থায় অংশীদারিত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণে আইন প্রণয়ন করা হউক (ইতোমধ্যে খসড়া বিল চূড়ান্তকৃত); বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন করা (ইতোমধ্যে খসড়া বিল চূড়ান্তকৃত); পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের যথাযথভাবে কার্যকর করা; এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গাপূজায় অষ্টমী থেকে দশমী-এ ৩ দিন, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমায় ১ দিন ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডে'তে ১ দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা।

এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ পুনর্গঠনে প্রস্তাবনাও জানানো হয় বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে।

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ড. নিম চন্দ্র ভৌমিক, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ প্রমুখ।

এমএসি/এমএ