যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে দেশটির একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করছে। প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কথা জানিয়েছে।

দুই দিনের সফরে শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় আসে মার্কিন প্রতিনিধি দল। এদিন, প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু প্রথমে দিল্লি যান। তারপর বিকেলে ঢাকায় পা রাখেন।

প্রতিনিধি দলের সফরের প্রথম দিনে কর্মযজ্ঞ খুব একটা ছিল না বললেই চলে। তবে সফরের দ্বিতীয় দিন আজ (রোববার) সকাল থেকে বেশ টাইট শিডিউলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে নেইম্যান-লুদের।

এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎ শুরু হয় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। সেখানে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেটি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেনি কোনো পক্ষই। তবে সেই বৈঠকের একটি ছবি প্রকাশ করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র।

এরপর অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে প্রতিনিধি দলটি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও। সাক্ষাৎ ছাড়াও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তির আয়োজন করা হয়। মূলত, বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলারের বেশি উন্নয়ন সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) চুক্তি সই হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি সই হয়েছে।

অনুষ্ঠান শেষে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় স্বাস্থ্য, সুশাসন, মানবিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি এবং মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এই অর্থ কাজে লাগানো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার হলো বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে সহযোগিতা করা।

চুক্তি ও সৌজন্য সাক্ষাৎ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতার পর অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কাউর।

সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, মার্কিন প্রতি‌নি‌ধি দ‌লের স‌ঙ্গে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দে‌শে ফেরা‌নোর বিষ‌য়ে আলোচনা হয়েছে। প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে, পরবর্তীতে আরও আলোচনা হবে।

ইউএসএআইডির অঞ্জলি কাউর জানান, বাংলাদেশকে ২০ কোটি ডলারের বেশি উন্নয়ন সহযোগিতা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। এর আওতায় সরকারের অগ্রাধিকার খাতে ২০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায়। আমরা এখন চুক্তি অনুযায়ী কাজ করব। এ চুক্তি মূলত সরকারের অগ্রাধিকারমূলক কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্য।

পরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে তার বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার উদ্দেশে রওনা হন অতিথিরা। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস দেশ পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চান।

প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তার সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভোট কারচুপি প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশন সংস্কার এবং বিচার বিভাগ, পুলিশ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে।

স্বৈরাচার সরকারের ঘনিষ্ঠ দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের মাধ্যমে আত্মসাৎ ও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্নীতির মতো বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, আমরা দুর্নীতির এক গভীর সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিলাম।

পরে আবার পদ্মায় আসে প্রতিনিধি দলটি। সেখানে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সভায় অংশ নেন তারা। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্রসচিব, যিনি প্রায় সবগুলো বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আর সব আলোচনা সম্পর্কে ওয়াকিবহালও।

পররাষ্ট্রসচিব জানান, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি বিশেষ অগ্রাধিকারে রয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংস্কার নিয়ে সরকারের ধারণা এবং যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এতে যুক্ত হতে পারে, তা নিয়ে ঢাকা সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাধারণ আলোচনা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করতে আগ্রহী।

জসীম উদ্দিন জানান, অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেগুলোর বিষয়ে প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বলে তাদের জানানো হয়েছে। আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা সংকটসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া–বিষয়ক সহকারী অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ঢাকায় আসার আগে দিল্লি সফর করেন। এই সফরে ভারত থেকে কোনো বার্তা নিয়ে এসেছেন কি না— জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এ বিষয়ে আজ কোনো আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশন আছে এবং ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশন আছে। আমরা যদি দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই, এগুলো আমাদের জন্য প্ল্যাটফর্ম।

নেইম্যানের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধি দলের সবশেষ আনুষ্ঠানিকতা ছিল বিকেলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক দিয়ে। বৈঠকে ম্যাক্রো ইকোনমি কীভাবে উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, পাচারের অর্থ ফেরানো ও প্রবৃদ্ধিসহ নানা বিষয় উঠে আসে।

আর্থিক খাত সংস্কারে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করবে বলে গভর্নরকে আশ্বাস দিয়েছেন ব্রেন্ট নেইম্যান।

অন্তর্বর্তী সরকারের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের আয়োজনে রাজধানীর অ্যাডওয়ার্ড এম কেনেডি (ইএমকে) সেন্টারে এক আলোচনায় অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান ও ইউএসএআইডির উপসহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কাউর।

সেখানে নেইম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে বাংলাদেশ সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত। যদিও এর কিছু কিছু অত্যন্ত কঠিন, তবে এসব ক্ষেত্রে যেকোনো সহায়তা দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

অঞ্জলি কাউর বলেন, আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় এসেছে। কারণ, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের  প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈদেশিক মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পর্যন্ত কথা বলেছি। এসব ক্ষেত্রে সরকারের বর্তমান অগ্রাধিকারে কীভাবে মানিয়ে নেওয়া যায় তা বোঝার চেষ্টা করেছি।

উল্লেখ্য, মার্কিন প্রতিনিধি দলে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চও ছিলেন।

এনআই/এমজে