ভারতের বেসরকারি সংস্থা ‘আদানি পাওয়ার’ ও আরও কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সংস্থার বাংলাদেশের কাছে মোট বকেয়ার পরিমাণ ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই অর্থের কিছুটা অন্তত এখনই পরিশোধ না-করা গেলে দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ আরও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলের শেষ দিক থেকেই বাংলাদেশ চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে, টান পড়েছে দেশের বৈদেশিক রিজার্ভেও। অথচ এই বকেয়া পরিশোধ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে খুব দ্রুতই অর্থের সংস্থান করতে হবে।

ভারতের যে সংস্থাটির বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্য অর্থের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, সেই আদানি পাওয়ার ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বরাবরে চিঠি লিখে তাদের পাওনা ৮০০ মিলিয়ন বা ৮০ কোটি ডলার মিটিয়ে দেওয়ার জন্য তার ‘হস্তক্ষেপ’ চেয়েছে।

আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় অবস্থিত তাদের যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করে থাকে, সেখান থেকে সরবরাহ এর মধ্যেই অন্তত ৫০০ মেগাওয়াট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুব দ্রুত বকেয়া মেটানো নিয়ে কোনও মীমাংসা না-হলে এই পরিমাণ আরও বাড়বে। 

এনটিপিসি-সহ ভারতের আরও বিভিন্ন যেসব রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সংস্থার বাংলাদেশের কাছে বিপুল অর্থ পাওনা আছে, তারাও দু-তিন মাস আগে থেকেই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠানোর পরিমাণ কমাতে শুরু করেছে।

তবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো এখনও ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারকে পেমেন্ট চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘তাগাদা’ দেয়নি – তারা আশা করছে ভারত সরকারই কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা চালিয়ে এই সংকটের একটা সমাধান বের করতে পারবে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই বিপুল পরিমাণ বকেয়া মেটানোর জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া না-হলে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ক্ষতিপূরণ চেয়ে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতেরও দ্বারস্থ হতে পারে। যদিও সেটা একেবারে শেষ ধাপ, এখনও সে রকম পরিস্থিতি আসেনি। 

আন্তর্জাতিক ব্রোকারেজ ফার্ম ‘বার্নস্টাইন’ও মনে করছে, পাওনা শোধ করা নিয়ে এই সমস্যার জেরে কিছু সময়ের জন্য এই সংস্থাগুলোর হয়ত ‘স্বল্পকালীন’ ভোগান্তি হবে – তবে মধ্যম বা দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে বিষয়টি এখনও উদ্বেগজনক মাত্রা নেয়নি!

এই পটভূমিতেই বুধবার বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, এই খাতের সংকট মেটানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিশ্ব ব্যাংক তাদের ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, এই অর্থ হাতে পেলে পাওনাদার সংস্থাগুলোর দাবি হয়ত অনেকটাই মেটানো সম্ভব হবে। তবে এই ঋণের টাকা কখন সরকারের হাতে আসতে পারে বা এটা দিয়ে পাওনাদারদের কাকে কতটা কী মেটানো হবে, তা নিয়ে কিছুই জানানো হয়নি।

 বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো কী বলছে?

বাংলাদেশের মোট বিদ্যুতের চাহিদার ১২ শতাংশ (বা তার সামান্য কমবেশি) ভারত থেকে সরবরাহ করা হয়। এখন ভারতের যে বিদ্যুৎ সংস্থাগুলোর মিলিতভাবে বাংলাদেশের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের ওপর পাওনা, তার মধ্যে আদানি পাওয়ার ছাড়াও আরও অন্তত সাতটি কোম্পানি রয়েছে।

এর মধ্যে আদানি পাওয়ারের পাওনা অর্থের পরিমাণই অবশ্য সবচেয়ে বেশি, ৮০ কোটি ডলার। তবে এ হিসেব ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ের , এরপর আরও আড়াই মাসের পাওনা অর্থ যোগ হবে।

 পাওনাদারদের তালিকায় বাকি সংস্থাগুলো হলো : সেইল এনার্জি ইন্ডিয়া লিমিটেড (পুরনো নাম সেম্বকর্প এনার্জি) – ১৫ কোটি ডলার, পিটিসি ইন্ডিয়া – ৮.৪৫ কোটি ডলার, এনটিপিসি (দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন) – ৬.৪৬ কোটি ডলার, এনটিপিসি (ত্রিপুরা) – ২.১৯ কোটি ডলার, এনটিপিসি – ১.৬৫ কোটি ডলার এবং পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন – ২ কোটি ডলার।

এর মধ্যে আদানি পাওয়ারের পক্ষ থেকে গত ২৭ অগাস্ট প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখে জানানো হয়েছে, তারা যাতে বিদ্যুৎ সরবরাহের অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারে সে জন্য এই ৮০ কোটি ডলার পরিশোধ করাটা জরুরি – কারণ ঋণদাতা সংস্থাগুলো তাদের প্রতি এখন ‘কঠোর মনোভাব’ দেখাচ্ছে।

পাওনা অর্থ পরিশোধের জন্য আদানি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি ‘ফর্মুলা’ও সুপারিশ করা হয়েছে।

মোটামুটিভাবে এই ‘ফর্মুলা’টা হলো : বিদ্যুৎ সরবরাহের অ্যারেঞ্জমেন্টটা টেঁকসই (‘সাসটেইনেবল’) রাখার জন্য বকেয়ার পরিমাণ কিছুতেই ৫০ কোটি ডলার ছাড়ানো চলবে না। ফলে বকেয়ার পরিমাণ এই সীমায় নামিয়ে আনতে হলে বাংলাদেশকে অবিলম্বে অন্তত ৩০ কোটি ডলার একবারে শোধ করতে হবে।

এছাড়া ১৬০০ মেগাওয়াট (পূর্ণ ক্ষমতা) বিদ্যুৎ আমদানির সাপেক্ষে বাংলাদেশের পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) প্রতি মাসে আদানিকে ৯ থেকে ৯.৫ সাড়ে কোটি ডলার মেটানোর কথা (‘মান্থলি রিসিভেবল’) – কিন্তু গত বেশ কয়েক মাস ধরে প্রতি মাসে বড়জোর ৪ থেকে ৪.৫ কোটি ডলার মেটানো হয়েছে বলেই বকেয়ার পরিমাণ এভাবে আকাশ ছুঁয়েছে।

কাজেই আদানি পাওয়ার সুপারিশ করেছে, পিডিবি প্রতি মাসে ‘মান্থলি রিসিভেবল’-এর এই পুরো পরিমাণটা মেটাতে থাকুক – তাতে বকেয়ার পরিমাণও বাড়বে না এবং পূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহও অব্যাহত থাকবে।

আদানি শিল্পগোষ্ঠীর একটি সূত্র বলেন, কোভিড মহামারির মধ্যেও মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে 'সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং ২০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে' গোড্ডার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও আলাদা ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে – কিন্তু এখন বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা ঠিকমতো না-পেলে তাদের জন্য ঋণের কিস্তি শোধ করাই মুশকিল হয়ে উঠছে!

আদানি পাওয়ার বাংলাদেশ সরকারকে সরাসরি ‘তাগাদা’ দেওয়ার রাস্তায় হাঁটলেও এনটিপিসি-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো অবশ্য এখনও সে ধরনের চরম পদক্ষেপ নেয়নি।
তবে এই সংস্থাগুলোর প্রায় সবাই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে ছাঁটাই করেছে।

যেমন, ত্রিপুরা থেকে প্রতি দিন বাংলাদেশে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাঠানোর ব্যাপারে সমঝোতা থাকলেও প্রায় চার-পাঁচ মাস হয়ে গেল কখনওই দৈনিক ৯০ থেকে ১১০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ পাঠানো হচ্ছে না। আর এর মূলেও আছে ঠিক সময়ে অর্থ পরিশোধ না-করা।

ত্রিপুরা স্টেট ইলেকট্রিসিটি কর্পোরেশন লিমিটেডের এমডি দেবাশিস সরকার বলেন, ঠিক সময়ে টাকাপয়সা না-পেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালিয়ে যাওয়া মুশকিল এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। কর্পোরেশনের ‘ক্যাশ ফ্লো’ (নগদ অর্থের প্রবাহ) কমে গেছে বলেই আমরা বিদ্যুতের জোগানে রাশ টানতে বাধ্য হয়েছি। 

তবে এই বিষয়টি ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে’র পর্যায়ে পড়ে এবং যেহেতু এর সঙ্গে একটি বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সম্পর্ক জড়িত – তাই বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়নি।

ত্রিপুরার কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে বিদ্যুতের পেমেন্ট নেওয়ার বিষয়টির তদারকি করে এনটিপিসি-র বাণিজ্যিক শাখা এনভিভিএন। ফলে তারা নিজেরা বাংলাদেশকে কোনো তাগাদা দেন না, তাদের হয়ে এই কাজটা এনভিভিএনেরই করার কথা।

দিল্লিতে এনটিপিসির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলছেন,একটি বেসরকারি সংস্থা হিসেবে আদানি পাওয়ার যেভাবে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি লিখে তাগাদা দিতে পারে, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি হিসেবে আমাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। 

তবে ঢাকার সঙ্গে নির্ধারিত কূটনৈতিক চ্যানেলের আলোচনায় দিল্লির পক্ষ থেকে এই প্রসঙ্গটি অবশ্যই উত্থাপন করা হচ্ছে বলে তারা নিশ্চিত।

বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে পাওনাদারদের ‘তাগাদা’ যে বাংলাদেশকে একটা চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্য তা খোলাখুলিই স্বীকার করছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বুধবার মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের অবস্থা হইল এখন গ্যাস নাই, অথচ পাওনাদার আছে। বিদ্যুৎ নাই, অথচ পাওনাদার আছে।’

সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দুই দিনের মধ্যে কাতার যেভাবে বাংলাদেশে গ্যাস পাঠাতে বেঁকে বসেছে, কিংবা আদানি গোষ্ঠী চিঠি লিখে পাওনা টাকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে তা সরকারকে তীব্র অস্বস্তিতে ফেলেছে বলেও জানান তিনি।

তবে এই সংকটের সমাধান খুঁজতে ইতোমধ্যেই তারা বিশ্ব ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছেন এবং তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে বলেও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা দাবি করেন।

তিনি বলেন, আমরা যেভাবে এ সেক্টরে সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছি, তাতে তারা খুবই সন্তুষ্ট। বিশ্ব ব্যাংক তো বলছে বহু জায়গায় তিন-চার বছরেও এত সংস্কারের কাজ সম্ভব হয় না। সে জন্যই তারা আমাদের ১ বিলিয়ন ডলারের মতো ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। একটা সেক্টরের জন্য আলাদাভাবে এই পরিমাণ ঋণ দেওয়ার ঘটনা খুব বিরল, তবু আমাদের জন্য তারা এটা করতে সম্মত হয়েছে।

তবে এই টাকা কবে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে, পাওয়া গেলে কীভাবে সেটা খরচ করা হবে বা পাওনাদারদের কাকে কতটা শোধ করা হবে – সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানাননি।

এদিকে বাংলাদেশের জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞও নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বলেন, আদানির সঙ্গে চুক্তিটি যতই বিতর্কিত হোক – এই মুহূর্তে আশু সংকট মেটাতে তাদের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসা প্রয়োজন। আদানির চুক্তিটা নিয়ে অনেক কথা হতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে আদানির সরবরাহ যদি বন্ধ হয়ে যায় তবে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কথা হচ্ছে যে আদানি ৮০০ মিলিয়ন ডলার পাবে, এটা তো তার চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য। এখন আমরা যদি না দিতে পারি টাকাটা, ওরাই বা কতদিন বাকিতে বিদ্যুৎ দেবে? 

সূত্র : বিবিসি বাংলা

এসকেডি