কলকারখানাসহ সকল ক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নতুন বাংলাদেশ গড়তে তিনি সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।

বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর একটি হোটেলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ‘ন্যাশনাল বিজনেস ডায়লগ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন।

জেনেভা কনভেনশনে যোগদান প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা বহুদিন পড়ে আছে, আমরা জেনেভা কনভেনশনে যোগ দিতে পারিনি। সবাই যখন একটা টিম হলাম; শ্রমিক, মালিক, সরকার সবাই যখন টিম হলাম ওটাও আমরা করে ফেলব।

তিনি বলেন, ওটা না করলে সামনে এগিয়ে যাওয়া কষ্টকর হবে। যেখানেই যাবেন এটা বাধা দেবে। পশ্চিমারা বলছে তোমরা শ্রমিকদের যা শর্ত, প্রাপ্য এগুলোতে তোমরা সই করছ না। কাজেই যদি আমাদের এগিয়ে যেতে হয় পরিষ্কার ভাবে হতে হবে।

ড. ইউনূস বলেন, আমাদের সাহস দিন, এগিয়ে আসেন, আমরা সবাই মিলে আইএলও কনভেনশনে স্বাক্ষর করে ফেলি।

তিনি বলেন, আমার একটা বড় আশা, যে মেয়াদকালে আমরা এখানে থাকব, শ্রমিক-মালিকের সম্পর্কটা সুন্দরভাবে গড়ে তোলা।

সবাই মিলে একজোট হয়ে কাজ করলে তরুণদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তোলা অবশ্যম্ভাবী এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে ড. ইউনূস বলেন, আমরা যে বড় কিছু করতে পারি তার প্রমাণ হলো ব্যবসায়ীরা। বিরাট দুঃসাহস নিয়ে আপনারা উদ্যোক্তা হয়েছেন। বাংলাদেশিদের কাছে শিল্পপতি হওয়া দুঃস্বপ্ন ছিল, কিন্তু আপনার সেটা করতে পেরেছেন। আপনারা বিশ্বমানের উদ্যোক্তা। যুবকরা যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা কাজে লাগিয়ে আপনারা স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবেন। 

তিনি বলেন, যুবকরা প্রাণের বিনিময়ে যে সুযোগ এনে দিয়েছে, তা জাতির জীবনে বারবার আসে না। নতুন করে যে স্বপ্ন আপনাদের মনে তারা জাগিয়ে দিয়েছে, সে স্বপ্ন যদি আপনার জীবনে রেখাপাত করে তাহলে সেই স্বপ্ন পূরণে আপনিও শরিক হবেন। এ সুযোগ আর কখনো আসবে কি না জানি না। এই সুযোগ যেন হারিয়ে না যায়। এই সুযোগ হারিয়ে ফেললে জাতির কাছে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ পারস্পারিকভাবে পরিচিত এবং একজনের সঙ্গে আরেকজনের যোগসূত্র রয়েছে। দুনিয়ায় এমন কোন দেশ পাওয়া যাবে না যেখানে পরস্পর পরস্পরের এমন ঘনিষ্ঠ। এখানে হয়ত কেউ সরকারে আছেন, কেউবা সরকারের বাইরে আছেন বা ব্যবসা করছেন। অথবা কেউ আছেন বিদেশে। কিন্তু আমাদের সবার সঙ্গে একটা যোগসূত্র আছে। পারস্পারিক এই যোগসূত্রই আমাদের বড় শক্তি যা আমাদের স্বপ্ন পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে।

ড. ইউনূস বলেন, যে কয়টা দিন সরকারে থাকি- আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই। আমাদের অঙ্গীকার হলো- নতুন বাংলাদেশের জন্য যা আছে তা করব। যেন বলে যেতে পারি, এ দেশ আমাদের একটা সুযোগ দিয়েছিল, আমরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি। স্বৈরাচার হটাতে ছাত্রদের এবারের আন্দোলন কোনো প্রথাগত আন্দোলন ছিল না। এটা সাধারণ কোনো আন্দোলন ছিল না। যারা শহীদ হয়েছেন, তারা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অনেকে শেষ বিদায় নিয়ে এসেছেন। তারা মনস্থির করেছিল যে উদ্দেশ্যে রাস্তায় নেমেছে, সে উদ্দেশ্যে প্রাণ দিতে তারা তৈরি আছে। রাস্তায় নেমেছে তাতে প্রাণ গেলে যাবে, কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে রাস্তায় নেমেছে সে লক্ষ্য অর্জন করবেই করবে। 

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তরুণরা প্রাণ দিয়েছে। যে বাংলাদেশে তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা তা অসহ্য হয়ে উঠেছিল। এ কারণে যখন ছাত্রদের প্রাণ ঝরছিল- তখন সারা দেশের মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে এমন কোনো মানুষ ছিল না তাদের সমর্থন করিনি। তাদের প্রাণের ফলে আমরা একটা নতুন সুযোগ পেয়েছি।

বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনায় অনেক বাধা রয়ে গেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ব্যবসায়ে বাধার কোনো সীমা নেই। ব্যবসা করা এক মহা সংগ্রাম। তবে আমরা এসব বাধা পেরিয়ে যেতে আজ একযোগে সরকার, সরকারের বাইরে সবাই এক পরিবারের সদস্য হিসেবে কাজ করে যাব। বাংলাদেশ নিম্ন মধ্য-আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্য-আয়ের দেশে উন্নীত হলে রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা হারাবে। কিন্তু আমাদের প্রতিযোগিতায় শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

দেশের প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াতে ব্যবসায়ীদের সামাজিক ব্যবসা চালুর আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আপনার গ্রাম, উপজেলা কিংবা আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এলাকায় সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলুন। বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা ও পরিবেশ উন্নয়নমূলক সামাজিক ব্যবসা করা যেতে পারে। আপনি বিনিয়োগ করবেন মুনাফার জন্য নয়, অন্যের সহায়তা বা সুবিধার জন্য।

সংলাপে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বক্তব্য রাখেন।

এনএম/এসকেডি