২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঝুট ব্যবসায়ী নুরু মিয়াকে নিজ বাসা থেকে র‍্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পৌনে ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো খোঁজ মেলেনি তার।

নুরু মিয়াকে যেদিন তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন তার ঘরে ছিলেন স্ত্রী আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ছেলে। সেই ছোট্ট শিশুটি আজ শৈশব পেরিয়ে তারুণ্যে। পড়ছেন ইন্টারমিডিয়েটে। তার নিখোঁজ বাবার সন্ধান এখনো দিতে পারেনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র। দেশের কোনো আদালতে, কোথাও বিচার পাননি তারা। নুরু মিয়াকে মেরে ফেলা হয়েছে নাকি এখনো জীবিত আছেন, তাও জানে না পরিবার।

সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকার ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব) কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উঠে আসে নুরু মিয়াসহ আরও অনেকের গুম হওয়ার নিদারুণ সব গল্প। স্বজনেরা গুম হওয়া ব্যক্তিদের দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। একই সঙ্গে দোষী ব্যক্তিদের ধরে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আহ্বান জানান।

নুরু মিয়ার ছেলে সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন আমার বাবাকে গুম করা হয় তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। আমি একা, মায়ের অনেক কষ্ট হয়েছে। দিনের পর দিন মায়ের হাত ধরে বাবাকে খুঁজে বেড়িয়েছি। আজ আমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, আজও বাবাকে ফিরে পাইনি। বাবা জীবিত নাকি মৃত তা আজও জানতে পারিনি।

সাইফুল বলেন, আমরা বাবার সন্ধানে জিডি করেছি, মামলা করেছি। নারায়ণগঞ্জের এমন কোনো থানা নেই যেখানে বাবার খোঁজ করিনি। খোঁজ তো পাইনি, উল্টো হয়রানির শিকার হয়েছি। চাপে পড়ে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছি। ভয়-ভীতি তো ছিলই।

সাইফুল আরও বলেন, আমাদের বুক ফাটা কান্না তখনকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শোনেনি। বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। আমাদের দাবি, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমার বাবার সন্ধান দেওয়া হোক। যে বা যারা আমার নিরপরাধ বাবাকে গুম করেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

এদিন ক্র্যাব কার্যালয়ে হাজির হয়েছিলেন গুমের শিকার অর্ধশতাধিক মানুষের পরিবারের সদস্যরা। সংবাদ সম্মেলন করে বেশ কিছু দাবি জানিয়েছেন তারা। আওয়ামী লীগ আমলে নিখোঁজ ও গুম ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়া এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আয়নাঘর উন্মোচন করে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন তারা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ গুম পরিবারের প্রধান সমন্বয়ক ও লেক্সাস গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ বেল্লাল হোসেন।

সংবাদ সম্মেলন শেষে কথা হয় পুরান ঢাকা থেকে গুম হওয়া রুবেলের মা রহিমা বেগমের সঙ্গে। ২০১৮ সালের ১৬ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কে বা কারা তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর সাড়ে ছয় বছর গড়িয়েছে, চোখের পানিও যেন শুকিয়ে গেছে, কিন্তু গুম হওয়া সন্তানের সন্ধান পাননি এই মা। 

রহিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিখোঁজের সাত মাস পর একবার ফোনে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। এরপর আবার সব বন্ধ। আজও ফেরেনি আমার রুবেল। 

পুরান ঢাকায় প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করতেন রুবেল। তার আয়ে চলতো সংসার। ছেলের সন্ধান না পেয়ে গ্রামে ফিরে যায় পুরো পরিবার।

মা রহিমা কেঁদে কেঁদে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আন্ডারগ্রাউন্ডে যত আয়নাঘর আছে সব ভেঙে ফেলা হোক। নতুন করে আর কোনো মায়ের সন্তান যেন গুম না হয় তা নিশ্চিত করা হোক।

গুমের শিকার আরেক ব্যক্তি হলেন সদরঘাট শ্রমিক দলের নেতা সানি হাওলাদার। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি রাতে পিরোজপুরের দুর্গাপুরের আত্মীয়ের বাসা থেকে র‍্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় তাকে। এখন পর্যন্ত তার আর খোঁজ মেলেনি।

সানি হাওলাদারের বাবা বাবুল হাওলাদার বলেন, অনেক থানায় খোঁজ করা হয়েছে। পিরোজপুর থানা শুধু বলছে চেষ্টা করছে। ওই চেষ্টা ছিল শুধু মুখেই। ছেলের সন্ধান যেমন পাইনি, তেমনি হারিয়েছি সদরঘাটের লেবারের কাজ, ইজারাদারিও। সরকার পরিবর্তনের পর আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। ছেলের সন্ধান দাবি করেছি। 

বাবুল হাওলাদার অভিযোগ করে বলেন, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের লোকদের সঙ্গে আমার ছেলে সানি হাওলাদারের ঝগড়া হয়। সেটাকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে পিরোজপুর থেকে র‍্যাব আমার ছেলেকে তুলে নিয়ে যায়। 

‘অনেক খোঁজাখুঁজির পরও আমার সোনার ধনরে (ছেলে) পেলাম না। কেউ আমার ছেলের সন্ধান দেয়নি। যার কাছে গেছি, সবাই বলে এটা অনেক উপর মহলের ঘটনা। খোঁজাখুঁজি করে লাভ নাই। আপনার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। ঘটনার পর থেকে কতবার থানা পুলিশ ও র‍্যাবের কাছে গেছি। কেউ আমাগো দিকে তাকায় নাই। সরকার পতনের পর থেকে অনেকেই আয়নাঘর থেরে বেরিয়ে আসছে। আমার ছেলে কই। আমার বাবার খোঁজ দিব কে?’

আরেক স্বজনহারা শারমিন আক্তার চাঁদনী বলেন, ২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজশাহী থেকে আমার ভাইকে র‍্যাব-৫ এর সদস্যরা নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আমরা থানায় থানায় ঘুরে কোনো প্রতিকার পাই নাই। সবাই বলেছে, এটা অনেক উপরের বিষয়। আর খোঁজাখুঁজি করে লাভ নাই। 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যতগুলো গুম, খুন ও অপহরণ হয়েছে। তার শতকরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ র‍্যাব করেছে। ক্রসফায়ারের নামে নাটক সাজিয়ে বিচার বহির্ভূতভাবে মানুষ মারা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে র‍্যাবের দায়িত্বে থাকা ডিজি, এডিশনাল ডিজি, ডিবিপ্রধান ও ডিজিএফআই প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। 

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের আমলে র‍্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আটকের পর গুম ও নিখোঁজ হওয়া অর্ধশতাধিক পরিবারের স্বজনরা।

সংবাদ সম্মেলনে যেসব দাবি তুলে ধরা হয়—

* অবিলম্বে গুম ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের টর্চার সেল বা আয়নাঘরের মতো বন্দিশালাগুলো থেকে নিঃশর্ত মুক্ত করা এবং নিজ নিজ পরিবারের কাছে ফেরত দিতে হবে।
* গুম ও নিখোঁজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে সবগুলো সেল দেখতে দিতে হবে।
* যাদেরকে মার্ডার বা খুন করা হয়েছে তাদের পরিবারকে প্রমাণস্বরুপ সনদ দিতে হবে।
* প্রতিটি নিখোঁজ পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
* স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো প্রকার গুম ঘর, টর্চার সেল (আয়নাঘর) থাকতে পারবে না, সব ভেঙে ফেলতে হবে।
* প্রশাসনিক গাড়ি কালো গ্লাস ব্যবহার করতে পারবে না।
* প্রতিটি গুম ও নিখোঁজ ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে সমন্বয়কদের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

জেইউ/এমজে