শহীদের মর্যাদা চায় পরিবার
শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন সোহেল
জুলাই মাসে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় তখন থেকে এ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ছিল মাহমুদুর রহমান সোহেলের। সর্বশেষ আগস্ট মাসের শুরুতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি সোহেল। নির্মম এমন হত্যাকাণ্ডে বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন, এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনিও ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে মাঠে নামবেন। নামেনও।
গত ৪ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় ছাত্রদের পক্ষে আন্দোলনে নামেন সোহেল। আন্দোলনের একপর্যায়ে যখন ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয় তখন ছাত্রদের পক্ষ নেন তিনি। পাল্টা ধাওয়া দেওয়ার সময় সামনের সারিতে অবস্থান নেন সোহেল। হঠাৎ দেখেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বিপদে পড়েছে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছোড়া গুলি মাথায় লাগে সোহেলের। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। গত ৯ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান সোহেল।
বিজ্ঞাপন
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মাহমুদুর রহমান সোহেল ঢাকার পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন এলাকার বাসিন্দা। তারা পাঁচ বোন, দুই ভাই। সবার ছোট সোহেল। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কার্গো বিভাগের সেলস ম্যানেজার মাহমুদুর রহমান সোহেল রাজধানীর উত্তরায় স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। সন্তানদের মধ্যে বড় ছেলে, বয়স ১৩। দুই মেয়ের বয়স যথাক্রমে ১১ ও দেড় বছর। উত্তরার একটি স্কুলে পড়াশোনা করেন তার বড় দুই সন্তান।
পারিবারিক ও কর্মজীবন মিলিয়ে খুবই সুখী ছিলেন সোহেল। রক্তাক্ত আগস্ট যেন সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারটি এখন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছে।
রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) নিহত সোহেলের ভাগনে নিলয় হাসান মোবাইল ফোনে ঢাকা পোস্টকে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন একের পর এক শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল। শিক্ষার্থীদের এমন মৃত্যু দেখে আমার মামা মাহমুদুর রহমান সোহেল বিচলিত হয়ে পড়েন, মর্মাহত হন। এসব অন্যায় দেখে তিনি বিবেকের তাড়নায় অস্থির হয়ে পড়েন। সিদ্ধান্ত নেন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াবেন, রাস্তায় নামবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাস্তায় নেমে পড়েন মামা।
শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতা যখন আন্দোলন করছিল তখন তিনিও এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। সন্ধ্যা পর্যন্ত থেকে অন্যায় বিরুদ্ধে কথা বলেন।
গত ৪ আগস্টের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নিলয় হাসান বলেন, ওই দিন মামার অফিস বন্ধ ছিল। অফিস থেকে বলা হয়েছিল বাসায় নিরাপদে থেকে কাজ করার জন্য। কিন্তু তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদে ৪ আগস্ট উত্তরা বিএনএ সেন্টারের সামনে ছাত্রদের সঙ্গে রাস্তায় নামেন। ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল, মামা সেখানে ছাত্রদের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।
‘হঠাৎ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে বাঁচাতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন মামা। ওই সময় উনার এক বন্ধু সঙ্গে ছিলেন। তিনি (মামার বন্ধু) আমাদের ফোন করে জানান, মামা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বেলা সোয়া ১২টার দিকে মামা গুলিবিদ্ধ হন। তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে ছাত্র-জনতা উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। মামার মাথায় ব্যান্ডেজ পরানো হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, মামার অবস্থা ভালো না, দ্রুত তার অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হবে না। আমরা দ্রুত তাকে উত্তরা হাইটেক মাল্টিকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
সেখানে মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচার শেষে চিকিৎসকরা বলেন, উনার মস্তিষ্কে গুলিটি এমনভাবে বিদ্ধ হয়েছে যে বের করা সম্ভব নয়, ৮০ শতাংশই ড্যামেজ। যে ২০ শতাংশ অক্ষত আছে তা দিয়ে উনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন। ৫ আগস্ট দুপুরে মামার উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ আগস্ট মারা যান মামা– যোগ করেন ভাগনে নিলয় হাসান।
মাহমুদুর রহমান সোহেলের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না– জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামার মৃত্যুর শোক তার পরিবার এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই এখনও কোনো মামলা করা হয়নি।
‘মামার পরিবারটি সম্পূর্ণ নির্ভর করতো তার উপার্জনের ওপর। তিনি ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কার্গো বিভাগের সেলস ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মামার পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করার মতো অবস্থা এখন আমাদের নেই। তার ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাবার মতো পরিস্থিতিও নেই। মানুষের কাছে গিয়ে যে হাত পেতে কিছু চাইব– এমন পরিবারও আমরা না। মামার এমন অকাল মৃত্যুতে পরিবারটি এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে কোনো চাওয়া আছে কি না– জানতে চাইলে নিলয় হাসান বলেন, আমরা চাই মামার পরিবারের সদস্যদের যেন কারও কাছে হাত পাততে না হয়। সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা যেন এগিয়ে আসেন। মামা দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন, এ মর্যাদা যেন সরকার তাকে দেয় এবং তার পরিবারকে দেয়। তার পরিবার যেন স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করতে পারে, সেই ব্যবস্থা যেন সরকার করে দেয়।
‘মামার স্ত্রী ও সন্তানেরা এ শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। দেড় বছরের বাচ্চাটা এখনও ঠিকভাবে বাবা বলতে শিখেনি। এর আগেই বাবা তাকে সারা জীবনের জন্য ছেড়ে চলে গেছে। মামার বাকি দুই সন্তান সারাক্ষণ বাবার কথা মনে করে কান্নাকাটি করে। বাবা নেই, কোনোভাবেই তারা সেটা মেনে নিতে পারছে না।’
আমরা চাই একটা ফিক্সড অ্যামাউন্ট সরকারের পক্ষ থেকে পরিবারটিকে দেওয়া হোক। যেন মামার পরিবার সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করতে পারে। আর মামি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাকেও যদি কোনো চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় তাহলে জাতির কাছে শহীদ এ পরিবারটি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে– বলেন শহীদ মাহমুদুর রহমান সোহেলের ভাগনে।
এমএসি/