দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করেন সাবেক ৫১ মন্ত্রী-এমপি। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি গাড়িটি এনেছেন দ্বাদশ সংসদে হবিগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচিত সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ওরফে ব্যারিস্টার সুমন। জাপানের টয়োটা ব্র্যান্ডের ল্যান্ড ক্রুজার এফজেএ ৩০০ ডব্লিউ মডেলের একটি গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করেন তিনি।

কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, শুল্ক সুবিধার আওতায় বেশিরভাগ গাড়ি জাপান ও সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা হয়েছে। টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, টয়োটা জিপ, টয়োটা এলসি স্টেশন ওয়াগন মডেলের এসব গাড়ির ইঞ্জিন ক্যাপাসিটি চার হাজার সিসি।

সংসদ সদস্যরা প্রতি পাঁচ বছরে একবার শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারেন। এ ধরনের গাড়ির ওপর কর ৮১০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে; তবে এমপিদের তা দিতে হয় না। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়নি।

এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দ্বাদশ সংসদের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দামের গাড়ি আমদানি করেছেন ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তার ব্যাংক ঋণপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, তিনি একটি গাড়ি আমদানির জন্য এক লাখ ১১ হাজার ডলারের (১ কোটি ২৬ লাখ টাকা) এলসি খোলেন। শুল্ককরসহ এ গাড়ির দাম পড়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকারও বেশি।

মূলত গাড়িটির কাস্টমস শুল্কায়নমূল্য পড়ে বাংলাদেশি টাকায় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা। এ ধরনের গাড়ির শুল্কহার ৮২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। এ হিসাবে শুল্ককর আসে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে দেশের বাজারে গাড়িটির দাম পড়বে প্রায় ১১ কোটি ৮০ লাখ টাকা।

গত ২০ জুন গাড়িটি খালাস করেন সায়েদুল হক সুমন। তিনি নিজেই গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ছয় লাখ টাকা অগ্রিম আয়কর দিয়ে গাড়িটি আমদানি করেছি। তবে এখনো নিবন্ধন করিনি। কারণ, আমার পুরোনো গাড়িটি বিক্রির পর মালিকানা বদলের প্রক্রিয়া শেষ হয়নি।

৫১ মন্ত্রী-এমপির মধ্যে ব্যারিস্টার সুমন, মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানসহ ৭ জন শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি ছাড়িয়ে নিয়েছেন। বাকিদের গাড়ি এখনো আটকে গেছে। মূলত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর সংসদ বিলুপ্ত হয়ে গেলে বিলাসবহুল গাড়ি আটকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কাস্টমস। বর্তমানে আটকে যাওয়া গাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করেছেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়জুর রহমান, লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক পিংকু, নাটোর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান মঞ্জু, সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরি, সাবেক সংসদ সদস্য ও চিত্রনায়ক ফেরদৌস, হবিগঞ্জের ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এবং বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সাবেক এমপি শাহজাহান ওমরসহ অন্তত ৫১ জন।

এদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি গাড়ি এনেছেন মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। গত ৩০ জুলাই তিনি গাড়িটি খালাস করেন। তিনি গাড়ি এনেছেন সিঙ্গাপুরের টয়োটা টুশো এশিয়া প্যাসিফিক প্রাইভেট লিমিটেড থেকে। তার গাড়ির ব্র্যান্ডও টয়োটা এলসি স্টেশন ওয়াগন জিআর-এস। গাড়িটির সিলিন্ডার ক্যাপাসিটি ৩ হাজার ৩৪৬।

সাকিব আল হাসানের গাড়িটির আমদানিমূল্য দেখানো হয় এক কোটি ১৪ লাখ জাপানি ইয়েন বা এক কোটি ৬ লাখ টাকা। এই গাড়িরও শুল্কহার ৮২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। গাড়িটির শুল্কায়ন মূল্য প্রায় এক কোটি ৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে গাড়িটির শুল্ককর আসে ৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান বলেন, ৬ আগস্টের আগে যারা শুল্কায়ন সম্পন্ন করেছেন তাদের গাড়ি খালাস হয়ে গেছে। তবে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার পর এমপি হিসেবে শুল্কমুক্ত সুবিধা আর তারা পাবেন না। এক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়ায় শুল্ক দিয়ে এসব গাড়ি খালাস নিতে হবে।

এদিকে, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা গাড়ি যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় কেউ খালাস না করেন তবে সেগুলো বিক্রি করতে পারে সরকার। গত বুধবার (২৮ আগস্ট) অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, সাবেক এমপিদের নামে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে আটকে থাকা শুল্কমুক্ত গাড়ি ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। ফেরত পাঠালে দেশ রাজস্ব হারাবে। তাই এই গাড়িগুলো বিক্রি করার শর্ত সহজ করে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এমজে