চৌধুরী নাফিজ সরাফাত

শুধু প্রতারণা বা জালিয়াতি নয়, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো (ওভার–ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানোর (আন্ডার–ইনভয়েসিং) মাধ্যমে হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। প্রাথমিক তদন্তে তার বিরুদ্ধে অর্থপাচারের তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে সিআইডি।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের অর্থপাচারসহ নানা অপকর্মে সহযোগিতা করায় তদন্ত হচ্ছে তার স্ত্রী আনজুমান আরা শহীদ, হাসান তাহের ইমাম এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে চাকরিজীবন শুরু করেন। বিদেশি এ ব্যাংকে থাকার সময় বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক হন তিনি। এক ব্যাংকে চাকরি আর অন্য ব্যাংকের পরিচালক হয়ে প্রশ্নের মুখে চাকরি ছাড়েন তিনি। ২০০৮ সালে যোগ দেন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে। এরও আগে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত একটি মিউচুয়াল ফান্ডের লাইসেন্স নেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে। লাইসেন্সের জন্য প্রথমে নিজের নামে আবেদন করেন। যেহেতু ব্যক্তির নামে লাইসেন্স দেওয়া হয় না, তাই বিএসইসি সদস্য মোহাম্মদ আলী খানের পরামর্শে তিনি কোম্পানি গঠন করেন। কোম্পানির নাম দেন বাংলাদেশ রেইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট। এতে তার মালিকানা ২৫ শতাংশ। বাকি মালিকানা হাসান ইমামের নামে।

ব্যক্তিস্বার্থে মিউচুয়াল ফান্ড ব্যবহার

সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে রেইস ম্যানেজমেন্ট পিসিএল নামে লাইসেন্স নেওয়া সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিটি সে সময়ে বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে। ২০০৮ সালে যাত্রা শুরুর পর ২০১৩ সালের মধ্যেই ১০টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পায় কোম্পানিটি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অধীনে ১৩টি ফান্ড রয়েছে। মূলত এসব মিউচুয়াল ফান্ড ব্যক্তিস্বার্থে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, তার স্ত্রী আনজুমান আরা শহীদ ও হাসান তাহের ইমাম। ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগ করে তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) শেয়ার কিনে ব্যাংকটির পর্ষদের পরিচালক বনে যান তারা। যদিও এ বিনিয়োগ থেকে ফান্ডগুলোর কোনো লাভ হয়নি। পরবর্তীতে কৌশলে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত তার স্ত্রী আনজুমান আরা শহীদকে সাউথইস্ট ব্যাংকের পরিচালক বানান।

বেস্ট হোল্ডিংস বন্ডে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে চাপ

সম্প্রতি বেস্ট হোল্ডিংস বন্ডে ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য চৌধুরী নাফিজ সরাফাত চাপ দেন বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল) নামের প্রতিষ্ঠানকে। রে্ইস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নিকট হতে অর্থ সংগ্রহ করে ১০টি মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করে। ফান্ডসমূহের সম্মিলিত আকার প্রায় ৪৫০০ কোটি টাকা।

মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থে এফডিআর, বঞ্চিত বিনিয়োগকারীরা

মিউচুয়াল ফান্ডের অর্থ দিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য যে এফডিআর খোলা হয়, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে সেই এফডিআর ভেঙ্গে ফেলা হয়। ফলে ফান্ডে বিনিয়োগকারীরা কোটি কোটি টাকার মুনাফা থেকে বঞ্চিত হন। এসটিডি/এসএনডি অ্যাকাউন্টে মাত্র ৩-৪ শতাংশ সুদে ফান্ডের ৬৫০/৭০০ কোটি টাকা জমা রাখা হয়। সুদের ২-৩ শতাংশ অর্থ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে আত্মসাৎ করা হয়।

পুঁজিবাজারের লভ্যাংশ আত্মসাৎ

পুঁজিবাজার থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশের ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ বিনিয়োগকারীদের মাঝে বণ্টনের নিয়ম থাকলেও রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সে নিয়ম না মেনে লভ্যাংশের অধিকাংশ টাকা আত্মসাৎ করে। এর নেপথ্যের কারিগর মূলত নাফিস সরাফাত।

ফান্ডের নামে না কিনে আত্মীয়দের নামে শেয়ার ক্রয়

সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আরও জানান, বিজিআইসি (BGIC) নামক ব্রোকারেজ হাউজে (যার অধিকাংশ শেয়ার সিইও হাসান ইমামের আত্মীয়-স্বজনের নামে ক্রয় করা) শেয়ার ক্রয়ের নিমিত্তে যে টাকা বিনিয়োগ করা হয়, তার একটি বড় অংশ ফান্ডের নামে ক্রয় না করে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের নামে শেয়ার ক্রয় করা হয়। এভাবে ফান্ডের বিনিয়োগকারীদের কোটি কোটি টাকার মুনাফা বঞ্চিত করে আত্মসাৎ করা হয়। মাঝে মাঝে ফান্ডের টাকা (৫০০-৭০০ কোটি) দিয়ে খুবই কৌশলে পুঁজিবাজারের কোনো একটি কোম্পানির বিপুল পরিমাণ শেয়ার ক্রয় করে ইচ্ছাকৃতভাবে এর দাম বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতিসাধন করা হয়। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর মেয়াদ (১০ বছর) উত্তীর্ণ হলেও বিনিয়োগকারীদের মুনাফাসহ সমুদয় অর্থ ফেরত না দিয়ে এসইসি ও আইসিবির (SEC ও ICB) যোগসাজশে মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ পুনরায় ১০ (দশ) বছর করে বৃদ্ধি করা হয়।

সিআইডি জানায়, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। ২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১৭১ দশমিক ১৬ কাঠার একটি প্লট কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিকে বরাদ্দ দেয় রাজউক। এতে সরকারের ক্ষতি হয় ৭৭ কোটি টাকা। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর মালিকানার পাশাপাশি নাফিজ সরাফাত আরগাস ক্রেডিট রেটিং সার্ভিসেরও চেয়ারম্যান।

এখানে উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর উত্থান হয় নাফিজ সরাফাতের। বিভিন্ন খাতের অন্যতম প্রভাবশালী হয়ে ওঠার নেপথ্যে তিনি সম্পর্ক গড়েন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সঙ্গে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তার সুসম্পর্কের চিত্র গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। গোপালগঞ্জে বাড়ি সূত্রে তিনি শেখ হাসিনাকে ‘ফুফু’ এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে ডাকতেন ‘চাচা’। সাবেক আইজিপি বেনজীরকে পরিচয় দিতেন ‘কাজিন’ হিসেবে।

শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে নাফিজ সরাফাতের সম্পর্কের কথা ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের প্রায় সবারই জানা। মাত্র ১৩ বছরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক, পুঁজিবাজার, বিদ্যুৎ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, গণমাধ্যমসহ আরও কিছু খাতে রহস্যজনক কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি পান নাফিজ সরাফাত।

সদ্যবিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে আর্থিক খাতের আলোচিত ব্যক্তি চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবে সব ধরনের লেনদেন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক খাতে অনিয়ম, ব্যাংক দখল ও পুঁজিবাজার থেকে টাকা লুটপাটের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

সর্বশেষ তিনি পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খান। তার পদত্যাগের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকও।

জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার বাছির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট কর্তৃক চৌধুরী নাফিজ সরাফাত, তার স্ত্রী আনজুমান আরা শহীদ ও হাসান তাহের ইমামসহ তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি, ওভার ইনভয়েস ও আন্ডার ইনভয়েস এবং সংঘবদ্ধ অপরাধের মাধ্যমে হুন্ডি কার্যক্রম পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচারের বিষয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে বেশকিছু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি। সত্যতার ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা হবে।

জেইউ/