চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সাইফুল বাহিনী প্রধান সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বুধবার (২৮ আগস্ট) দণ্ডবিধি ও বিস্ফোরক আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় সাতকানিয়া থানায় মামলাটি রেকর্ড হয়। পরে বিষয়টি জানাজানি হয়। তবে মামলা রেকর্ড করা হলে এখনো আলোচিত সন্ত্রাসী সাইফুলকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

সবশেষ দায়ের হওয়া মামলায় সাইফুলসহ মোট ৮১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ১০০ থেকে ১৫০ জনকে। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান।  তিনি বলেন, মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ১৮ জুলাই সাতকানিয়ার কেরানীহাট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রজনতা শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিল। এতে  আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। শুরুতে তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। লাঠিসোঁটা, হকিস্টিক দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে পাঁচজনকে আহত করে তারা। মামলার বাদী মো. তসলিম ওই হামলায় আহত মো. সিফাতের বাবা।

জানা গেছে, সাইফুলের বিরুদ্ধে এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা, আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে চাঁদা আদায় এবং সাধারণ মানুষের জায়গাজমি ও বসতভিটা দখল করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কথায় কথায় লোকজনের ওপর হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুরসহ নানা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার কারণে এলাকাজুড়ে আলোচিত তিনি। ২০২২ সালে সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতি করে মেম্বার হন সাইফুল। একাজে তাকে সহযোগিতা করেন তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য আবু রেজা মো. নেজাম উদ্দিন নদভী। 

মেম্বার হওয়ার পর থেকে একেবারে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েন সাইফুল। চরতী ও তার পার্শ্ববর্তী আমিলাইশ ও নলুয়া ইউনিয়নে তিন ইউনিয়নেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সাইফুল বাহিনী। পুরো এলাকায় তার কথায় ছিল শেষকথা। তিনি চাইলে লোকজনকে হামলা করে বসতভিটা ছাড়তে হয়। ইচ্ছে হলেই যে কাউকে মারধর করতেন সাইফুল। আবার ইচ্ছে হলে পরিত্যক্ত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করতেন সাধারণ মানুষকে। একাজে তাকে সহযোগিতা করতেন সাতকানিয়া থানার কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা। চাঁদার টাকার একটা অংশও যেত তাদের পকেটে। 

জানা গেছে, সাইফুলের বাড়ি চরতী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। আন্তঃজেলা ডাকাত সর্দার মৃত নুর আহমেদের ছেলে সাইফুল একসময় প্রবাসী ছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি দেশে ফেরেন। ২০১৭ সালের দিকে দেশে ফিরে এলাকায় গঠন করেন কিশোর গ্যাং। চরতীর বুক চিরে বয়ে যাওয়া সাঙ্গু নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন শুরু করেন। একই সঙ্গে ইয়াবার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন সাইফুল।

ইয়াবা এবং বালু বিক্রির টাকায় বাহিনীর জন্য কেনেন অস্ত্র। এই অস্ত্রের ভাণ্ডার মজুত রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি থেকে চাঁদা আদায় করতে থাকে সাইফুল বাহিনী। সাতকানিয়ার রাজনীতিতে যখন যে প্রভাবশালী ছিলেন তার ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে এই সাইফুল। ২০২২ সালে সংসদ সদস্য আবু রেজা নদভীর সহায়তায় ইউপি মেম্বার নির্বাচিত হন সাইফুল। এরপর তাকে ছেড়ে উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোতালেবের কাছে আশ্রয় নেন তিনি।

২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে মোতালেব সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাইফুল এবং তার বাহিনী। গত ছয় মাসে সাতকানিয়ার চরতি-আমিলাইশ এলাকায় অন্তত ৩০টি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে এই বাহিনী। থানা পুলিশ জানিয়েছে, এরমধ্যে কমপক্ষে ২০টি অভিযোগ জমা পড়েছে এই বাহিনীর বিরুদ্ধে। বাকিরা ভয়ে মুখ খুলেনি। 

২০১৮ সালে সন্ত্রাসী সাইফুল বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে যায় দক্ষিণ চরতির ১০ পরিবার। নারী ও শিশুসহ এসব পরিবারের প্রায় অর্ধ শতাধিক লোকজন দীর্ঘ এক বছর নিজেদের ভিটে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর উদ্বাস্তুর মতো দিনযাপন করে। বাড়ি-ভিটে ফিরে পেতে ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেন উদ্বাস্তু পরিবারসহ এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাইফুল ইসলামকে একাধিক ফোন দিলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

এমআর/জেডএস