ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কী পরিমাণ অর্থ টোল হিসাবে আদায় হবে সেটি নির্ধারণে ১৫ সদস্যের একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। 

গঠিত কমিটি এক্সপ্রেসওয়েতে বিদ্যমান সড়ক ও সব সেতুর টোল সমন্বয় করে তা নির্ধারণ করবে। নির্দিষ্ট একটি স্থান থেকে এ টোল আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে। 

রোববার (৩ জানুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে অংশীজনদের নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) এ বৈঠকের উদ্যোগ নেয়। 

বৈঠকে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল নির্ধারণে ১৫ সদস্যের উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। উপ-কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে সওজ অধিদপ্তরের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খানকে। 

এ এক্সপ্রেসওয়েতে বিদ্যমান সব সেতুর টোল সমন্বয় করে টোল নির্ধারণ করা হবে। একটি স্থানে গাড়ি থেকে টোল আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে।

সওজ অধিদপ্তরের ঢাকা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলো থেকে নিয়মিত টোল আদায় হয়ে থাকে। ওইসব দেশের মতো বাংলাদেশেও টোল ধার্যের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধাপে ধাপে দেশের সব জাতীয় মহাসড়ক থেকে টোল আদায় হবে। প্রথম উদ্যোগ হিসেবে টোল নেওয়ার জন্য ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে বিদ্যমান সেতুগুলো নির্ধারণ হয়েছে।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে এ প্রসঙ্গে জানান, সরকার মহাসড়ক থেকে টোল আহরণ করবে। কিন্তু জনগণ তো কর দিচ্ছেই। হানিফ উড়াল সেতু নির্মাণের পর টোল নেওয়া শুরু হয়। এ পথে চলাচলকারী গাড়ির ট্রিপও বেড়েছে। তারপরও টোল দিতে হচ্ছে। এটা যাত্রীর পকেট থেকে দেওয়া হচ্ছে।

‘মহাসড়কে টোলের হার যৌক্তিক হলে তা সহনীয় মাত্রায় রাখতে হবে’— বলেন মোজাম্মেল হক।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম এর আগে বলেছিলেন, দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক চার লেন করা হয়েছে। ছয় লেনের মহাসড়কও হচ্ছে। এছাড়া এক্সপ্রেসওয়েও নির্মাণ হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চার লেন, ছয় লেন মহাসড়ক ও এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চললে টোল নেওয়া হয়। আমরাও টোল কীভাবে নেওয়া যায় তা নির্ধারণ করব।

সওজ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরই মধ্যে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গাড়ি চলাচলে কী হারে টোল দিতে হবে, তার একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এখনও চূড়ান্ত হয়নি। ঢাকা থেকে মাওয়ামুখী যানবাহন রাজধানীর ধোলাইপাড় দিয়ে প্রবেশ করে চারটি স্থানে টোল দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বের হবে। এ এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকামুখী গাড়িগুলো ভাঙ্গা থেকে আড়িয়াল খাঁ, শ্রীনগর, ধলেশ্বরী ও আবদুল্লাহপুরে টোল দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করবে। কোনো গাড়িকে একাধিকবার টোল দিতে হবে না।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ঢাকা পোস্টকে জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গাড়ি চললে কী হারে টোল দিতে হবে তা নির্ধারণের কাজও শুরু হয়েছে। ধাপে ধাপে জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা, এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর, ঢাকা বাইপাস, রামপুরা-আমুলিয়া-ডেমরা মহাসড়কসহ বিভিন্ন মহাসড়কে টোল নেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহার করলে দিতে হবে টোল 

দেশে সড়ক ও মহাসড়কের ওপর নির্মিত ব্রিজ, সেতু থেকে টোল আদায়ের রীতি রয়েছে। এবার জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহার করলেও টোল দিতে হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, ব্রিজ, সেতুর পাশাপাশি জাতীয় মহাসড়ক থেকে টোল আদায়ের। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে বর্তমান সরকারের ১৪তম জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এ নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। 

সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘ব্রিজে আমরা টোল নেই। সড়ক নয়, জাতীয় মহাসড়কগুলোতে থাকা (যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-রংপুর জাতীয় মহাসড়ক) ব্রিজ ছাড়াও রাস্তার ওপর টোল বসানো হবে। সারাবিশ্বে তাই আছে। টোলে কত টাকা নির্ধারণ হবে, সেটা ঠিক করব এখন। কারণ এইভাবে আর পারা যাবে না।’

কাদের দিতে হবে টোল

মহাসড়কে যে টোল দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটি কি যাত্রীবাহী বাস, ছোট গাড়িগুলোকেও দিতে হবে নাকি শুধুমাত্র পণ্যবাহী ট্রাকের ওপর প্রযোজ্য হবে? এ বিষয়ে এখনও পরিষ্কার করে কিছু বলেনি বাংলাদেশের সরকার।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, যারা সড়ক ব্যবহার করেন, যাওয়া-আসা করবেন, তারাই এই টোল দেবেন। যেভাবে অন্যান্য দেশে আছে, সেভাবেই এখানেও ব্যবস্থা করা হবে। সেটা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা হতে পারে।

টোল নীতিমালায় যা আছে

সরকার প্রণীত টোল নীতিমালায় বলা হয়েছে, দেশের সব জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক-মহাসড়ক, জেলা সড়ক ও উড়াল সড়কে গাড়ি চালানোর জন্য নির্ধারিত হারে টোল দিতে হবে। নীতিমালা হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সংসদে পাস করার প্রয়োজন পড়বে না।

যানবাহন ভেদে সর্বনিম্ন পাঁচ টাকা ও সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা টোল আরোপ করা হবে। কনটেইনারবাহী ট্রেইলার, ট্রাক, বাস থেকে শুরু করে রিকশা, ভ্যান, বাইসাইকেল, ঠেলাগাড়ি সব ধরনের যানবাহন ১৩টি ক্যাটাগরিতে টোলের আওতায় আসবে। এছাড়া সব সেতু ও ফেরিতে একক কাঠামোর আওতায় টোল আদায় করা হবে।

নীতিমালা অনুযায়ী, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ব্যবহারে ট্রেইলারের টোল হবে এক হাজার টাকা, ভারী ট্রাক ৮০০, মাঝারি ট্রাক ৪০০, বড় বাস ৩৬০, ছোট ট্রাক ৩০০, মিনিবাস ২০০, কৃষিকাজে ব্যবহৃত যানবাহন (ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার) ২৪০, মাইক্রোবাস, পিকআপ ১৬০, ব্যক্তিগত গাড়ি ১০০, অটোরিকশা, টেম্পো ৪০, মোটরসাইকেল ২০ ও রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি ১০ ও বাইসাইকেল ৫ টাকা। 

জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহারে টোলের হার হবে উল্লিখিত পরিমাণের চার ভাগের তিন ভাগ, আঞ্চলিক মহাসড়কের ক্ষেত্রে অর্ধেক ও জেলা সড়কের ক্ষেত্রে চার ভাগের এক ভাগ। তবে দৈর্ঘ্য ভেদে টোলের হার পরিবর্তন হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার চাইলে যেকোনো সড়ককে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করে সর্বোচ্চ হারে টোল আরোপ করতে পারবে।

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে

এদিকে ২০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যরে সেতুর ওপর টোল আরোপ করা হবে না। তবে ২০১ থেকে ৫০০, ৫০১ থেকে ৭৫০, ৭৫১ থেকে এক হাজার ও এক হাজার মিটারের অধিক দৈর্ঘ্যের সেতুর জন্য নির্ধারিত হারে টোল দিতে হবে। এক্ষেত্রে যানবাহনের আকার ভেদে টোলের হার নির্ধারণ করা হবে। 

অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা

সাধারণত ইউরোপ, আমেরিকার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সড়কে একাধিক সড়ক বা উড়ালসেতুর ব্যবস্থা থাকে। সাধারণ জনগণ সরকারি সড়কে চলাফেরা করেন। আর যারা বেশি টাকা ব্যয় করতে সক্ষম তারা যানজটমুক্ত হয়ে দ্রুত যাওয়ার জন্য বেসরকারিভাবে নির্মিত সড়ক বা উড়ালসেতু ধরে যাতায়াত করেন। এজন্য তারা টোল দেন। কিন্তু সরকারি সড়কের ক্ষেত্রে কোথাও জনগণকে কর দিতে হয় না। এসব সড়কে কিছুটা যানজট থাকে। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনার সড়কগুলো দিয়ে দ্রুত যাতায়াত করা যায়। কারণ টোল গুনে সবাই তাতে ওঠে না। যেখানে টোল দিতে হয়, তার আশেপাশে অবশ্যই টোলবিহীন সড়কও থাকে, যা দিয়ে সাধারণ জনগণ যাতায়াত করে। 

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি, হল্যান্ড ও বেলজিয়ামের হাইওয়েতে কোনো টোল নেই। ইতালিতে হাইওয়েতে টোল আছে কিন্তু বড় শহরের মধ্যে ঢুকতে-বেরোতে প্রায় ১০/২০ কিলোমিটার ফ্রি। যেমন ভেনিস, মিলান। ফ্রান্সেও এমনই

পিএসডি/এমএআর/