ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রাকে করে নৌকা-স্পিডবোট নিয়ে বন্যায় প্লাবিত এলাকার মানুষজনকে উদ্ধারে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবী মানুষজন। অনেকে কভার্ড ভ্যান, ট্রাক, পিক-আপ ভরে নিয়ে যাচ্ছেন শুকনো খাবার, জরুরি ওষুধ, নিরাপদ পানি, চাল-ডাল। কিছু জায়গায় বানভাসিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে নগদ অর্থ। আবার বন্যার্তদের সহযোগিতায় অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কর্মীরা একদিনের বেতন দান করেছেন। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে দাতা প্রতিষ্ঠানে সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা পৌঁছে দিতেও দেখা গেছে। অর্থাৎ যে যার জায়গা থেকে যেভাবে পারছেন সেভাবেই দাঁড়াচ্ছেন বানভাসি মানুষদের পাশে। অনেকেই বলছেন, দুর্যোগ ঘিরে এমন ‘একতাবদ্ধ বাংলাদেশ’ আগে দেখেননি তারা।

মূলত, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যা সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে ফেনীতে। এছাড়া চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজার জেলাও বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব জেলাগুলোতে বন্যায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেক জায়গায় মানুষ মারা যাওয়ার পর কবর দেওয়ার জায়গাও মিলছে না। এমন পরিস্থিতিতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে  সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন সাধারণ বেসামরিক মানুষজনও। এর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল, সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও ফান্ড সংগ্রহ করছেন।

অরাজনৈতিক, অলাভজনক এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, তারা ৫০০ টন ত্রাণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া এরইমধ্যে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) তাৎক্ষণিক ১০ টন খেজুর, ১০ টন চিড়া, ৫ টন চিনি, ৫ টন লবণ ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আমাদের তিনটি ট্র্যাক ফেনী পৌঁছেছে। সেসব মালামাল পাঁচ হাজার পরিবারের মধ্যে বিতরণ করার কার্যক্রম চলছে। ত্রাণের ব্যাগে প্রতিটি পরিবারকে এজন্য প্রথম ধাপে ২ কেজি খেজুর, ২ কেজি চিড়া, ১ কেজি লবণ ও ১ কেজি চিনি দেওয়া হয়েছে।

এরপর দ্বিতীয় ধাপে আবারও আরও ৩৫ হাজার পরিবারের জন্য শুকনো ও ভারী ত্রাণসামগ্রীর ব্যবস্থা করেছে সংগঠনটি। যার জন্যে ৫০০ টন মালামাল কেনা হয়েছে।

যার মধ্যে আছে, ২০০ টন চাল, ২০ হাজার বোতল তেল (২ লিটারের) ৩০ টন খেজুর, ৩০ টন চিড়া, ৪০ টন ডাল, ২৭.৫ টন লবণ, ১৫ টন চিনি, ২০ হাজার পিস পানির বোতল (৫ লিটারের) এবং দেড় লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, মোমবাতি ও দিয়াশলাই। এসব মালামাল ঢাকায় প্যাকেজিং করা হচ্ছে।

এদিন সকাল থেকে প্যাকেজিংয়ের কাজে স্বেচ্ছাসেবা দিতে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের আফতাবনগর কার্যালয়ের সামনে লাইন ধরে মানুষজনকে দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গেছে।  

এছাড়া বন্যা দুর্গতদের জন্য এস. এ. গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ৮০০ পিস ৫ লিটার পানি এবং ৭৫০ পিসের ১ কেজি করে লবণ আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনকে উপহার দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা।

টিএসসিতে চলছে ‘গণত্রাণ সংগ্রহ’ কার্যক্রম

বন্যার্তদের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে গতকাল থেকেই চলছে গণমানুষের গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে এই কার্যক্রমে প্রথমদিনেই অসংখ্য মানুষ সাড়া দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান প্রথমদিনেই প্রচুর খাদ্য সামগ্রী, পোশাক, স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং প্রায় ১৫ লাখ টাকা সংগৃহীত হয়েছে। আজও সকাল ১০টা থেকে টিএসসিতে এই কার্যক্রম চলছে।

এখানেও অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে নজির স্থাপন করছেন। গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচিতে ৬ বছর ছোট্ট ইহান নিয়ে এসেছেন ৩ বছর ধরে জমানো সব টাকা। পুরো প্লাস্টিকের ব্যাংকই তুলে দিয়েছেন বানভাসি মানুষের সহযোগিতার জন্য। এমন অনেকেই যার যার অবস্থান থেকে দাঁড়িয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মেডিকেল টিমের সমন্বয়ক আব্দুল মুনঈম বলেন, সাধারণ জনতার এমন একতাবদ্ধ প্রয়াস আগে কখনও দেখা যায়নি। সবাই নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। আমরা মানুষের এমন সাড়ার ব্যাপারে অবাক হয়েছি। মনে হচ্ছে, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজ শুরু হয়েছে। এটি আমাদের প্রথম পরীক্ষা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস সবাই মিলে একসাথে এই পরীক্ষা জয় করবো।

দুর্গোৎসবের বাজেট থেকে বন্যার্তদের জন্য অর্থ সহায়তা

এবার বন্যা ঘিরে সম্প্রীতির এক নতুন নজির সৃষ্টি করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরাও। তাদের দুর্গোৎসব আয়োজনের বাজেট থেকে বন্যাদুর্গতদের অর্থ সহায়তা পাঠিয়েছে বরিশালের বেশ কয়েকটি মন্দির কমিটি। আরো কয়েকটি কমিটি সহায়তা পাঠাতে তহবিল প্রস্তুত করেছে বলে জানা গেছে।

বরিশালের সবচেয়ে বড় শ্রী শ্রী শংকর মঠ পূজা উদযাপন কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তন্ময় দাস বলেছেন, ফেনী-কুমিল্লাসহ ১০টি জেলায় বন্যায় মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। আমাদের শংকর মঠের পক্ষ থেকে দুর্গোৎসবের জন্য যে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছিল তার বড় একটি অংশ বন্যাদুর্গতদের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেখানে আমাদের মন্দিরের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি স্বেচ্ছাসেবী দলও পাঠানো হয়েছে। আরো কয়েকটি মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার টাকার বেশি পাঠানো হয়েছে। আমরা আরও কিছু কমিটির সাথে যোগাযোগ করেছি এবং সকলের প্রতি আহ্বান রেখেছি দুর্গত এলাকার মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য।

সর্বোচ্চ সক্ষমতা নিয়ে কাজ করছে পুলিশ, সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী

বন্যা দুর্গত সাধারণ মানুষজনের সহযোগিতায় কাজ করছে পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থা। উদ্ধার তৎপরতার পাশাপাশি রান্না করা খাবারও বিতরণ করছেন তারা। এছাড়া এরকম এলাকাগুলোতেই হেলিকপ্টারের মাধ্যমে উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছেন তারা।

বন্যার্তদের সহযোগিতায় ১ দিনের বেতন দিচ্ছেন অনেকেই

আকস্মিক বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষজন। এরইমধ্যে বিকাশ, নগদ এবং ঢাকা পোস্টের কর্মীরা তাদের ১ দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বন্যার্তদের জন্য দান করেছেন। বন্যার্তদের সহযোগিতায় প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে একদিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দিয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল পর্যায়ের সদস্যরাও। এছাড়া আরো সরকারি, বেসরকারি অফিস এবং স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গঠন করা হয়েছে ত্রাণ তহবিল।

বন্যার্তদের জন্য ফ্রি মিনিট ও ইন্টারনেট দিয়েছে অপারেটররা

বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ফ্রি টকটাইম এবং ইন্টারনেট সুবিধার ঘোষণা দিয়েছে দেশের অপারেটররা। সবার আগে তারাই বন্যার্তদের জন্য সহযোগিতামূলক উদ্যোগ নিয়েছে। দেশের ৪টি বেসরকারি অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, রবি এবং এয়ারটেল এবং সরকারি অপারেটর কোম্পানি টেলিটকের পক্ষ থেকে এমন সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে জুমার নামাজে বয়ানে ইমামদের আহ্বান

ভয়াবহ ও আকস্মিক এই বন্যায় ১৫টিরও বেশি জেলায় তৈরি হয়েছে মানবিক বিপর্যয়। এমন অবস্থায় বানভাসি ও বন্যাকবলিত মানুষদের পাশে সামর্থ্য অনুযায়ী দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন মসজিদের খতিবরা। এক্ষেত্রে অনেক মসজিদে কমিটির পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে ত্রাণ সহায়তা বিতরণ করার উদ্যোগ।

শুক্রবার রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ মসজিদগুলোতেই খতিবরা জুমার নামাজের আগের খুতবায় বর্তমান পরিস্থিতি ও বন্যার্তদের ভয়াবহ কষ্টের কথা তুলে ধরেন। জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো মুসলমানদের বড় দায়িত্ব এমন কথাও বলেন তারা। আর নামাজের পর এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ চেয়ে আল্লাহর কাছে করা হয় বিশেষ দুআ ও মোনাজাত। এ সময় অনেক মুসল্লিরাই কান্নায় ভেঙে পড়েন।

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে আগ্রহী অনেক মানুষ

সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য-সহায়তা করার জন্য অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন। আর বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই মহতী আগ্রহকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকেও স্বাগত জানানো হয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিরা প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলের সহায়তার অর্থ পাঠাতে পারবেন।

◑ হিসাবের নাম : ‘প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’

◑ ব্যাংক : সোনালী ব্যাংক কর্পোরেট শাখা, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় 

◑ হিসাব নম্বর : ০১০৭৩৩৩০০৪০৯৩

এ তহবিলের অর্থ ত্রাণ ও কল্যাণ কাজে ব্যয় করা হবে বলেও জানানো হয়েছে।

আরএইচটি/পিএইচ