১৯৯৪ সালে ১৩তম বিসিএসে টেলিকম ক্যাডারে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন সুনীল কুমার অধিকারী। ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে উপ-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এই কর্মকর্তা। ৩০ বছর চার মাসের এই চাকরিকালে উপ-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পাঁচ বছর ছয় মাসের বেশি সময়।

নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে তার চাকরিকাল ২০ বছর অতিবাহিত হলে এবং উপ-সচিব পদে তিন বছর দায়িত্ব পালন করলে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তিনি পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন।

২০০১ সালের ৩১ মে ২০তম বিসিএস (কর) ক্যাডারে যোগ দেন ড. মো. নুরুল আমিন। ২৩ বছর তিন মাসের এই চাকরিকালে উপ-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ৬ বছর ৬ মাসের বেশি সময়। নিয়ম অনুযায়ী, এই কর্মকর্তার যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার কথা থাকলেও তিনিও বঞ্চিত হয়েছেন।

আরেক কর্মকর্তা তাহমিনা সুলতানা ১৯৯৯ সালের ২৫ জানুয়ারি ১৮তম বিসিএসে কৃষি ক্যাডারে যোগ দেন। ২৫ বছর সাত মাসের এই চাকরিকালে তিনিও উপ-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ছয় বছর ছয় মাসের বেশি সময়। নিয়ম অনুযায়ী এই কর্মকর্তার পদোন্নতি পাওয়ার কথা থাকলেও তিনিও পদোন্নতি পাননি।

উপ-সচিব হিসেবে পুলভুক্ত ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ জনই প্রশাসন ক্যাডারের। বিসিএসের কোনো একটি সার্কুলারের মোট কর্মকর্তার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের এবং ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ অন্য ২৫টি ক্যাডারের। কিন্তু উপ-সচিব পদে পদোন্নতির সময় চিত্রটি একদম পাল্টে যায়। প্রশাসন ক্যাডারের এই ১৫ থেকে ২০ শতাংশ থেকে উপ-সচিব করা হয় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ। অন্য ২৫টি ক্যাডারের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ থেকে উপ-সচিব করা হয় মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ

কেবল সুনীল কুমার অধিকারী, ড. মো. নুরুল আমিন কিংবা তাহমিনা সুলতানাই নন, পদোন্নতির জন্য সব মানদণ্ডে যোগ্য বিবেচিত হয়েও অদৃশ্য কারণে উপ-সচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন প্রশাসন ক্যাডার ব্যতীত ১৩ থেকে ২২তম ব্যাচের ১৯৫ জন কর্মকর্তা। অন্যদিকে, প্রশাসন ক্যাডারের প্রায় সব কর্মকর্তাই নিয়মিত ব্যাচের সঙ্গে পদোন্নতি পেয়েছেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসন ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হলেও সর্বশেষ গত ১৮ আগস্ট তাদেরও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হয়েছে।

এদিকে, বৈষম্যের শিকার অন্যান্য ক্যাডারের যেসব উপ-সচিব ইতোমধ্যে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করেছেন এবং এক বা একাধিকবার পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, গত ১৮ আগস্টের পদোন্নতি আদেশে তাদের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে পুনরায় বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। এতে করে মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্য স্বত্বেও ২৫টি ক্যাডারের মধ্যে ১৩ থেকে ২২তম ব্যাচের ১৯৫ কর্মকর্তাকে জ্যেষ্ঠতা হারিয়ে তাদের অনেক জুনিয়র কর্মকর্তার অধীনে কাজ করতে হচ্ছে। যা সব আইন ও বিধিমালার লঙ্ঘন এবং বৈষম্যহীন ও মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন গড়তে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এদিকে, বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা তাদের পদোন্নতির দাবিতে গত ১২ এবং ১৪ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন সচিবের কাছে স্মারকলিপি দিলেও এখনো মেলেনি সুরাহা।

পদোন্নতি পেতে বাধা নেই; আইন কী বলছে?

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক সিভিল আপিল এনওএস ২৯৪-৯৮ অব ২০০৩-এ প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে, যখনই কোনো কর্মকর্তা ২০০২ সনের বিধিমালা অনুসারে উপ-সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হলেন, তাহা যেকোনো ক্যাডার হতেই হোক না কেন, তিনি তখন একজন পরিপূর্ণ উপ-সচিব।

তার পূর্বের ক্যাডার পরিচয় তখন বিলুপ্ত হবে। সচিবালয়ের উচ্চতর উপ-সচিব পদে তখন তিনি অধিষ্ঠান। সেই অধিষ্ঠা নিয়েই অন্য সব উপ-সচিবের সাথে একশ্রেণীভুক্ত হয়ে সম-অধিকার লইয়া তিনি পরবর্তী উচ্চতর যুগ্মসচিব পদে বা পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য বিবেচিত হবেন। অথচ এসএসবি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ আদালতের উপরিল্লিখিত পর্যবেক্ষণও আমলে নেওয়া হচ্ছে না।

কী বলা হয়েছে স্মারকলিপিতে?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং পরবর্তী মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন সচিবের কাছে দেওয়া ওই স্মারকলিপিতে কর্মকর্তারা বলেছেন, সচিবালয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী কার্য সম্পাদনের জন্য উপ-সচিব ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সিনিয়র সার্ভিস পুল গঠন করা হয়। ‘সরকারের উপ-সচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২’ অনুযায়ী প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্য ২৫টি ক্যাডার হতে ২৫ শতাংশ উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে এ পুল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যদিও প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য সংখ্যা চার হাজার ৮৯৯ জন (৯ দশমিক ৬২ শতাংশ) এবং অন্যান্য ২৫টি ক্যাডারের সদস্য সংখ্যা ৪৬ হাজার ২৩ জন (৯০ দশমিক ৩৮ শতাংশ)।

এতে আরও বলা হয়, পরবর্তী পদোন্নতি, অর্থাৎ যুগ্মসচিব ও এর ওপরের পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে পিএসসির সুপারিশ পাওয়া নিজ নিজ ব্যাচের সম্মিলিত মেধাতালিকা, সরকারি চাকরি আইন, পদোন্নতি বিধিমালা, সুপ্রিম কোর্টের রায় কোনো কিছুই মানা হয় না। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের সব কর্মকর্তার নিয়মিত ব্যাচের সঙ্গে পদোন্নতি নিশ্চিত থাকলেও অন্য ২৫টি ক্যাডারের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক কোটা আরোপ করে প্রশাসন ক্যাডারের অনেক জুনিয়র ব্যাচের সঙ্গে স্বেচ্ছামূলক নামমাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ পদোন্নতি দেওয়া হয়।

বৈষম্যের শিকার অন্যান্য ক্যাডারের যেসব উপ-সচিব ইতোমধ্যে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করেছেন এবং এক বা একাধিকবার পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, গত ১৮ আগস্টের পদোন্নতি আদেশে তাদের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে পুনরায় বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। এতে করে মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্য স্বত্বেও ২৫টি ক্যাডারের মধ্যে ১৩ থেকে ২২তম ব্যাচের ১৯৫ কর্মকর্তাকে জ্যেষ্ঠতা হারিয়ে তাদের অনেক জুনিয়র কর্মকর্তার অধীনে কাজ করতে হচ্ছে

উপ-সচিব হিসেবে পুলভুক্ত ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ জনই প্রশাসন ক্যাডারের। বিসিএসের কোনো একটি সার্কুলারের মোট কর্মকর্তার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রশাসন ক্যাডারের এবং ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ অন্য ২৫টি ক্যাডারের। কিন্তু উপ-সচিব পদে পদোন্নতির সময় চিত্রটি একদম পাল্টে যায়। প্রশাসন ক্যাডারের এই ১৫ থেকে ২০ শতাংশ থেকে উপ-সচিব করা হয় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ। অন্য ২৫টি ক্যাডারের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ থেকে উপ-সচিব করা হয় মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।

আবার যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির সময় চিত্রটি আবার একদম বিপরীত হয়ে যায়। সম্পূর্ণ মেধা এবং পেশাভিত্তিক বিশেষজ্ঞ ক্যাডার থেকে উপ-সচিব হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তাদের স্ব-স্ব প্রশাসন ক্যাডারের ব্যাচের সঙ্গে ১ শতাংশকেও পদোন্নতি দেওয়া হয় না। অর্থাৎ প্রশাসন ক্যাডারের যে ব্যাচকে বিবেচনায় নেওয়া হয়, সেই ব্যাচের অন্য ২৫টি ক্যাডারের কাউকেই (হাতে গোনা ২/১ জন ছাড়া) পদোন্নতি দেওয়া হয় না, অথচ তারা মেধাতালিকার অন্তর্ভুক্ত।

কী বলছেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা?

পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, এ বৈষম্যের কারণে একদিকে যেমন জনপ্রশাসন মেধাহীন ও দক্ষ জনবলশূন্য হয়ে পড়েছে, পাশাপাশি জনপ্রশাসনে চেইন অব কমান্ডও পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। বিগত সরকারের আমলে প্রশাসন ক্যাডারের কতিপয় কর্মকর্তা এ বেআইনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটি মেরুদণ্ডবিহীন, রাজনৈতিক পদলেহনকারী জনপ্রশাসন তৈরি করা হয়েছে। তাদের প্রেতাত্মা এখনও সক্রিয় থেকে একই পদ্ধতি অনুসরণ করছে, যা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল বর্তমান সরকারের নীতি-আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থি।

তারা বলছেন, ক্রমাগতভাবে আমাদের প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করায় ক্যাডার/শ্রেণি বিভাজন সৃষ্টি করা হয়েছে; যা সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং সংবিধানের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন। পদোন্নতি বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা বেতন স্কেলের শেষ ধাপে আছেন বিধায় এ পদোন্নতির ক্ষেত্রে সরকারের অতিরিক্ত কোনো অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না।

পদোন্নতি না দিলে আসছে বড় আন্দোলনের ডাক

বঞ্চিত একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে পদন্নোতির আবেদন করেও যদি পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয় এবং ক্যাডার ভিত্তিক বৈষম্য প্রকট করা হয়, তবে সামনে কঠোর কর্মসূচি হাতে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

তারা বলেছেন, আমাদের দাবি বাস্তবায়ন না হলে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব। একই সঙ্গে দাবি বাস্তবায়নে যা যা করার সবকিছু করব। একই সঙ্গে আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে আইনগত ব্যবস্থা নেব।

বঞ্চনার শিকার নিয়ে যা বলছেন সমন্বয়ক

এ বিষয়ে ২৫ ক্যাডারের অন্যতম সমন্বয়ক ও উপ-সচিব ড. মো. নুরুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি এ পদোন্নতি দেবেন। কিন্তু বারবার দিনক্ষণ পাল্টানো হচ্ছে৷ গত মঙ্গলবার থেকে ইন্টারনাল কাজগুলো শেষ করে এসএসবির মিটিংয়ে আমাদের পদোন্নতির বিষয়টি উঠানোর কথা ছিল। কিন্তু তারা বিষয়টি মিটিংয়ে উঠাচ্ছেন না। এটা নিয়ে গড়িমসি হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এখনো বৈষম্যের ভূত রয়েই গেছে৷

তিনি বলেন, যখন কেউ চেষ্টা করেও বঞ্চিত হয় তখন কিন্তু বিদ্রোহ করে। আমরা তাদের প্রতি সম্মান রেখে এবং প্রক্রিয়া অনুসরণ করেও যদি পদোন্নতি না পাই তাহলে শক্ত অবস্থানে যেতে বাধ্য হব। 

তিনি বলেন, আমরা বৈষম্য চাই না। আমরা একটা নতুন দেশ চাই। চাই স্বচ্ছ এবং যোগ্য লোকগুলো সামনে আসুক। তারা নেতৃত্ব দিক। যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের এমন একটা বোধ থাকা চাই। আমরা বৈষম্যহীন মেধাভিত্তিক জনপ্রশাসন চাই। যদি আবারও দলীয় লেজুড়বৃত্তি, দলবাজি হয় তাহলে এ দেশের আর উন্নতির সম্ভাবনা নেই।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্‌ উদ্দিন চৌধুরী এবং নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফকে একাধিকবার কল করা হলেও তারা রিসিভ করেননি। 

এমএম/কেএ