২০১৬ সালের ৯ আগস্ট মিরপুর ডিওএইচএস থেকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান) সাদা পোশাকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘আয়নাঘর’ নামে গোপন কারাগারে। সেখানে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা তার হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে রাখা হতো। দিন, সময় ও তারিখ তাকে জানতে দেওয়া হতো না। এমনকি আজানের ধ্বনিও শুনতে দেওয়া হতো না।

গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর চোখ বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে গোপন কারাগার থেকে বের করা হয় ব্যারিস্টার আহমদ বিন কাসেমকে। ৪০ বছর বয়সী আহমেদকে একটি গাড়ি থেকে ঢাকার উত্তর উপকণ্ঠে একটি কর্দমাক্ত খাদে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি এএফপিকে বলেন, ‘আট বছরে এই প্রথম আমি তাজা বাতাস পেলাম। আমি ভেবেছিলাম ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’

আট বছরের অন্ধকার জীবনের ভয়াল অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানিয়েছেন গণমাধ্যমকে। প্রায় আট বছর আরমানকে দুর্বিষহ যন্ত্রণাদায়ক সময় পার করতে হয়েছে। বন্দিশালার নির্যাতন যেন হার মানায় কল্পিত গল্পকেও। সেইসব দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আরমান বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়েছিল, আমি জীবন্ত অবস্থায় কবরের মধ্যে থাকছি। আমি যদি জানতাম, আমার সঙ্গে এই আচরণ করা হবে, তাহলে আমি দুটি মেয়েকে একটু আদর করে দিয়ে আসতাম। আমি এত দ্রুত আলাদা হয়ে যাব, চিন্তাও করতে পারিনি।’

আহমদ বিন কাসেম বলেন, ‘আমাকে বলা হয়নি আমি কোথায় আছি। আমাকে বলা হয়নি, আজকে কত তারিখ। এখন কয়টা বাজে, এটাও তারা বলত না। আমি বলতাম, আমি নামাজ পড়ব কীভাবে? তখন তারা বলত, এটাই আদেশ। সময় বলা যাবে না। আশপাশে মসজিদ ছিল, আজান শোনা যেত। যখনই আজান শোনা যেত, তখনই তারা মিউজিক ছেড়ে দিত। যেন আজান শুনতে না পাই। তারা বলত, এটাই আদেশ। কেউ যেন সময় বুঝতে না পারে, লোকেশন বুঝতে না পারে। আজান শুনতে না পারে। এভাবে আটটি বছর কেটে গেছে। একমাত্র ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’

কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে ব্যারিস্টার আরমানের। আট বছর পর মায়ের কাছে ফিরে আসাটা আরমানের কাছে কল্পনারও অতীত, স্বপ্নের মতো। আরমানের কাছে সময়টা এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। ২০১৬ সাল আরমানের আকাশ গুটিয়ে যায় পৃথিবীর আলো থেকে। শুরু হয় অচেনা অন্ধকারে চোখবাঁধা এক অধ্যায়ের। জীবনের আটটি বছর কালো কাপড়ে বাঁধা ছিল আরমানের দুচোখ।

আরমান বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা চোখ বেঁধে রাখা হতো। নাক থেকে কপাল পর্যন্ত চোখটা বাঁধা থাকতে হবে, যেন সামনে যিনি থাকবেন তাকে দেখা না যায়। এমনকি দিনের আলোটাও যেন দেখা না যায়। এভাবে চোখ বাঁধা থাকার নিয়ম। ২৪ ঘণ্টা হাতকড়া পরানোর নিয়ম। দিনের বেলা সামনে, রাতের বেলা পেছনে হাত বাঁধা থাকত। রাত ১২টা পর্যন্ত হাতের সামনে, রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত পেছনের দিকে। শুধু রমজান মাসের রোজা শুরুর রাতে তারা বলত, আজকে চাঁদ দেখা গেছে, তারাবির নামাজ পড়েন। রমজান মাসে সেহেরি ও ইফতার দেওয়া হতো। কর্মীদের জন্য খাবারের বরাদ্দ যতটুকু, তার হাফ বন্দিদের জন্য বরাদ্দ ছিল।’

ব্যারিস্টার আরমান বলেন, ‘আমি রাতের পর রাত কাটিয়েছি বন্দিদের কান্নার আওয়াজে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে শিশুর মতো চিৎকার করতে শুনেছি আমি। মানুষের চিৎকার ও নির্যাতনের আওয়াজে আমি বহু রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। এমন কথাও আমার কানে আসত, মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। কয়েকজন বন্দি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তাদের হাত-পা বেঁধে নাকের নল দিয়ে খাওয়ানো হয়েছে। খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় মৃত্যুর আশঙ্কা হতো, তখন তাদের ভিটামিন ইনজেকশন দেওয়া হতো; মৃত্যু যাতে না হয়। বন্দিদের মৃত্যুর চেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা দেওয়া হয়।’

তিনি জানান, ‘২০১৬ সালের আগস্ট মাসের রাতে সাদা পোশাকে এসে তারা আমাকে বলে, আমাদের কিছু প্রশ্ন রয়েছে। আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে। আমি জানতে চাইলাম, তারা কারা? তখন আমাকে বলে, একটু কষ্ট করে আমাদের সঙ্গে চলেন। গেলেই বুঝতে পারবেন। আমি যেতে চাইনি। তখন দেখলাম, তারা বল প্রয়োগ করছেন। ঘরে বাচ্চারা রয়েছে, নারীরা রয়েছে। এদের সামনে সিনক্রিয়েট করার কোনো সুযোগ নেই। তখন আমি তাদের কো-অপারেট করলাম। গাড়িতে তুলে তারা আমার চোখ বেঁধে ফেলল। তখন বললাম, আমি তো আপনাদের সঙ্গে কো-অপারেট করছি, চোখ বাঁধছেন কেন? তারা বলেন, এটাই আমাদের নিয়ম। আমি চিন্তা করতে পরিনি, কখনো দুনিয়ার আলো দেখতে পারব। আমার বিশ্বাস ছিল, মৃত্যু এখানেই হবে। আর যদি স্বৈরাচার সরকার থাকতে না পারে, হয়ত যাওয়ার আগে আমাকে হত্যা করে তারপর যাবে।’

আহমদ বিন কাসেম বলেন, ‘যখন আমাকে সেল থেকে বের করে গভীর রাতে, আমি ভেবেছিলাম আমাকে মেরে ফেলা হবে। পরে আমাকে একটা খোলা প্রান্তরে চোখ বাঁধা অবস্থায় নামানো হয়। আমি মনে করেছি, এখনই গুলির আওয়াজ শুনব। তারপর আমি আর থাকব না। তারপর জোরে গাড়িটি চলে গেল। এক ঘণ্টা পর আস্তে আস্তে চোখটা খোলার চেষ্টা করলাম। দেখলাম, অন্ধকার একটি মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। একটা আলো দেখা যাচ্ছিল। দু’ঘণ্টা হাঁটার পর আমি ওখানে গিয়ে পৌঁছাই। ওখানের লোকজন আমাকে জানায় যে এটা দিয়াবাড়ি। তখন বুঝতে পারলাম, আমাকে দিয়াবাড়ি ড্রপ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার, মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার, মৌলিক সামাজিক অধিকার, মৌলিক ধর্মীয় অধিকার, মৌলিক ব্যক্তিগত জীবনের অধিকার কেউ কখনো কেড়ে নিতে পারে না।’

এসএসএইচ