পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও ট্রায়াল দাবি করেছেন বিডিআর বিদ্রোহে নিহত তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া।  

তিনি বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত শেখ হাসিনা, তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ ফজলুল করিম সেলিম। আমি নাটক সাজানোর নামে রহস্যশালা আর চাই না।

শনিবার (১৭ আগস্ট) দুপুরে মহাখালী রাওয়া ক্লাবের স্কাইলাইন রেস্টুরেন্টে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের কথা বলতে গেলে অনেক কথাই গুছিয়ে বলা কঠিন হয়ে যায়। আমার বাবা সব সময় বলতেন, মানুষের স্বার্থ আগে দেখতে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর দেশ প্রেমিক অনেক সেনা অফিসার বিচার চাইতে গিয়ে চাকরি হারিয়েছেন। কেউ কেউ জেলে গেছেন। দরবারের শত শত অফিসারের জীবন ধ্বংস করা হয়েছে। 

আমরা দাবি করছি, তদন্ত কমিশন গঠন করা হোক। আমরা সেসব দেশ প্রেমিক অফিসারদের অবদান ভুলবো না। আমরা চাই নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা হোক। ক্ষতিগ্রস্ত সেনা অফিসারদের পরিবারকে যেন যথাযথ সম্মান ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। আমরা শহীদ পরিবার মনে করি- যেসব নির্দোষ, দেশপ্রেমিক বিডিআর সৈনিক জেল খাটছেন, সুষ্ঠু তদন্তে যেন তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।

রাকিন আহমেদ বলেন, আপনারা সাংবাদিকরাও কম নির্যাতনের শিকার হননি। অনেক কিছুই প্রকাশ করতে পারতেন না। এক আওয়ামী লীগ নেতা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন- ওনার নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমার বাবা-মাকে জবাই দিয়েছেন। যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি তাহলে বাবা-মার মতো আমাকেও জবাই দিয়ে দেবে। 

শাকিল আহমেদের ছেলে বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই- যেখানে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) অন্য একটা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে রাজধানীতে ৫৭ সেনা অফিসারকে হত্যা করে। ওই দিনটিকে আমরা শহীদ সেনা দিবস দাবি করছি। 

তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচারের ট্রায়াল বা তদন্তকে আমরা মানি না। কারণ প্রধান যে হত্যাকারী, নির্দেশদাতা তিনি তখন ক্ষমতায় ছিলেন। খুনি কী তার নিজের বিচার করবে? মুখ বন্ধ করে দেখতে হয়েছে, কেমন করে তদন্ত, ট্রায়াল প্রভাবিত করলো, ডাল ভাতের কথা বলল। নীরবতায় সহ্য করতে হয়েছে। 

সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী এগিয়ে যায়। তাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই ছাত্র-জনতার ওপর গুলি না করে এগিয়ে এসেছেন। জনগণকে অনুরোধ করবো, সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করুন। 

সংবাদ সম্মেলন থেকে পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঠিক বিচার দাবি করেছে শহীদ পরিবার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনীর হাতে থাকা ট্র্যাজেডির সমস্ত তদন্তের রিপোর্ট জনসম্মুখে প্রকাশ, তদন্ত কমিশন গঠন, ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ সেনা দিবস ঘোষণাসহ পিলখানায় শহীদ ৫৭ অফিসার ও ১৭ সাধারণ নাগরিকের পরিবারের পক্ষ থেকে ৭ দফা দাবি তুলে ধরা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহী রহমান শফিকের ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান ৭ দফা দাবি তুলে ধরেন।

১. পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সত্য উদঘাটনের ক্ষেত্রে পূর্বে যে সমস্ত তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তের রিপোর্ট পাবলিক করতে হবে।

২. হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় মোতাবেক তিনজন জজ যে তদন্ত কমিশনের কথা বলেছেন, অবিলম্বে সেই তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। এতে পর্দার আড়ালে রয়ে যাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বেরিয়ে আসবে।

৩. অফিসিয়াল গ্যাজেট করে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। গ্যাজেটে শাহাদাতবরণকারী সকলকে শহীদের মর্যাদা দিতে হবে। 

৪. ২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ সেনা ও শোক দিবসকে ঘিরে গোটা দেশজুড়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে। 

৫. পিলখানা ট্রাজেডিকে স্কুলের পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে, কি ছিল এই শহীদদের ত্যাগ।

৬. যে সকল সেনা কর্মকর্তা এ ঘটনাকে ঘিরে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, তাদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা যথাযথ কম্পেন্সেশন প্রদান করতে হবে।

৭. নির্দোষ কোনো বিডিআর সদস্যকে যেন কোনভাবেই সাজা না দেওয়া হয়। 

এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট সাকিব বলেন, দুটো তদন্ত কমিটি হয়েছিল। বাহিনীর পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের সাবেক মহাপরিচালক লেফট্যানেন্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর। যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আমরা খুব করে চাইবো অন্তত তার তদন্ত কমিটির রিপোর্টটা পাবো। কারণ আমরা খুব কাটছাঁট অংশ গণমাধ্যমে জেনেছি। আমরা পুরোটাই দেখতে চাই। তাতে আমরা অনেক কিছু জানতে পারবো। আর উচ্চ আদালত যে তদন্ত কমিশনের কথা বলেছেন, সেগুলো যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে পর্দার আড়ালে যারা ষড়যন্ত্রকারী তারা বেড়িয়ে আসবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা চার্জ করতে পারবো। 

গত ১৫ বছর যারা ক্ষমতায় ছিলেন পিলখানা হত্যাকাণ্ডে তাদের দায়ী করছেন কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন আইনজীবী হিসেবে আমি তো সরাসরি দায়ী করতে পারি না। আমরা তো অনেক নাম শুনি। আপনারাও শোনেন। কিন্তু সেই নামগুলো আমরা তখনই বলতে পারবো যদি তদন্তের মাধ্যমে বেড়িয়ে আসে। এমনি এমনি নাম বলে দেওয়া যায় না। 

পিলখানা সত্য উদঘাটন তো হয়নি। সত্য উদঘাটনের পর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করবে কারা? জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই এটার দায়িত্ব সরকারের। এই মুহূর্তে হয়তো পর্দার আড়ালে ষড়যন্ত্রকারীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারবো না, কিন্তু আপাতত ঘটনাটা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। যখন ষড়যন্ত্রকারীদের নাম বের হবে তখন তা যুক্ত করা হবে। 

ষড়যন্ত্রকারী কারা? তাদের আইনের আওতায় আনতে লিগ্যালি কি করার পরিকল্পনা রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মনে করি ষড়যন্ত্রকারী আছে। ইন্টারন্যাশনাল কন্সপিরেসি আছে কি না সেটা তো তদন্ত কমিশন বসলে ভালো করে জানতে পারবো। তবে আমরা যদি আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারি, তাহলে ওই সময় কোনো ব্যক্তিবর্গ জড়িত থেকে থাকে তাহলে ব্যবস্থা নিতে পারবো। কিন্তু রাষ্ট্রই যদি ইন্টারন্যাশনাল কন্সপিরেসি করে থাকে তাহলে তো পুরো রাষ্ট্রকে বিচারের আওতায় আনতে পারবো না। 

কর্নেল কুদরত ইলাহীর স্ত্রী লবী রহমান বলেন, হয়তো বলবেন, এতদিন পর কেন আমরা এখানে। অনেক কিছুই তো পেয়েছি। কিন্তু গত ১৫ বছরে আমরা কিন্তু শুধু বিচারই চেয়েছি। প্রথমেই আমাদের প্রশ্ন করা হয়, কি কি পেয়েছি। ইচ্ছে হয় সব ফেরত দেই, আমার স্বামী শহীদ কর্নেল কুদরত ইলাহীকে ফিরিয়ে দেন। এটা সিনেমা বা নাটকের প্রমোশন না, এটা খুবই সেনসিটিভ।

জেইউ/এমএসএ