নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে বাংলাদেশকে ঢেলে সাজাতে চায়। এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কূটনীতিতে। আর এর দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন। যিনি অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা।

কঠিন সময়ে দায়িত্ব পেয়ে সময় নষ্ট করতে রাজি নন তৌহিদ হোসেন। ইতোমধ্যে প্রাথমিক কাজ প্রায়ই সেরে ফেলেছেন। এর ধারাবাহিকতায় বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনারদের সঙ্গে কথা বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, দিয়েছেন বিভিন্ন দিকনির্দেশনা।

দূতদের দিকনির্দেশনার মূল বার্তা ছিল- দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সরকার ছাড়াও মানুষে মানুষে যেন সম্পর্ক তৈরি হয় সেদিকে জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ফোকাস করতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ)।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ভার্চুয়ালি বাংলাদেশের মিশন প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করার পাশাপাশি দূতদের বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন।

জানা গেছে, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জেনেভা, সৌদি আরব, স্পেন, রাশিয়া, ব্যাংকক, মালদ্বীপ, ফ্রান্স, মরক্কো ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জার্মানির দূতরা সাম্প্রতিক সময়ের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলেন এবং উপদেষ্টার দিক নির্দেশনা চান।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। ছবি- সংগৃহীত

ভার্চুয়াল ওই বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব মো. নজরুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে উপদেষ্টা সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষাপটে বক্তব্য রাখেন। এরপর দূতরা তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেন।

বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, দেশের পরিস্থিতি কী হয়েছিল, তা সবাই জানেন। এটা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখন রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সবার নিশ্চয়ই মনে আছে- এর আগে ২০১৮ সালেও শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। তখন সড়কে একটি ছোট্ট ব্যানার ছিল, সেখানে লেখা ছিল- এখানে রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে। ২০১৮ সালে যে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিল আমার মনে হয় এই সময়ে এসেও তারাই আন্দোলন করেছে।

তিনি বলেন, কারণ ওই সময়ের যে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল, তারা তখন স্কুলে পড়ত। সেই শিক্ষার্থীরাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গোটা দেশ যোগ দিয়েছে। এই সময়ের আন্দোলনে সহিংসতা যত বেড়েছে তত বেশি মানুষের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি কারা সেটা বুঝতে হবে। যারা আন্দোলন করেছে তাদের কাছ থেকে পরিবর্তনের যে বার্তা এসেছে সেটাও বুঝতে হবে। আর ওরাই কিন্তু আমাদের (উপদেষ্টা পরিষদ) ডেকে এনে বসিয়েছে, আমরা নিজে থেকে আসিনি। পরিবর্তন বা সংস্কারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তারা ড. ইউনূসকে অনুরোধ করেছে।

দূতদের উদ্দেশে উপদেষ্টা বলেন, এই সময়ে আমাদের কাজ করতে হবে। শিক্ষার্থীরা বড় পরিবর্তনের ডিমান্ড করেছে। রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে। এখানে আন্তর্জাতিক পরিসরে আমরা যা করতে পারি তার মধ্যে একটা হচ্ছে রাজনৈতিক পরিসরে বিষয়টি ডিফেন্ড করা, সুবিধা নেওয়া, ক্ষেত্র বিশেষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হবে সেগুলোর সমাধান করা। দেশের আইন শৃঙ্খলা এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে। অর্থনীতিও লাইনে নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রাথমিক কাজ শেষে আমাদের মূল সংস্কারের দিকে যেতে হবে।

তৌহিদ হোসেন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অনন্তকাল থাকতে পারবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ৯০ দিনের সময়সীমা থাকে। কিন্তু আমাদের সময় সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আমরা আগে মূল সংস্কারের বিষয়গুলো চিহ্নিত করবো, সেগুলো কোন পদ্ধতিতে করবো, তারপর বলতে পারবো যে কত সময় লাগবে। তবে এটা সুস্পষ্ট যে আমরা সংস্কার করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবো। আমরা একটা নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেব।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আবার যেন নির্বাচন আগের মত না হয়- গত ৩টা নির্বাচন কেমন হয়েছে তা সবাই জানি। নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেন আমাদের ছেলেদের আর রাস্তায় নামতে না হয়, সেজন্যই অমরা কাজ করবো।

পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে উপদেষ্টা দূতদের বলেন, বিদেশ নীতিতে আমাদের ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় এই মূলমন্ত্রের পরিবর্তন হবে না।’ আমরা চাই যে প্রতিবেশীসহ সকলের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হোক। মানুষ যাতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্কটা উপলব্ধি করতে পারে। ভারতের সঙ্গে আমরা সত্যিকারের দীর্ঘস্থায়ী ভালো সম্পর্ক গড়তে চাই। চীন-ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে চাই। যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা পছন্দ করি বা না করি কিন্তু তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি স্বার্থ তাদের সঙ্গে।

তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদেরকে বড় প্লেয়ারদের সঙ্গে ডিল করতে হয়। আমরা ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে চাই। যারা যত বেশি বড় দেশ তারা তত বেশি গুরুত্ব পাবে। আমাদের নিজেদের স্বার্থ বজায় রেখেই সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। ছোট দেশগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে ছোট দেশগুলোও আমাদের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যেমন বাহরাইন বা আমিরাতে বাংলাদেশের বড় সম্প্রদায় বসবাস করে, সেখানে আমাদের স্বার্থ আছে।

বৈঠকের এক পর্যায়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বর্তমানে মিশনগুলোতে যে ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা সমালোচনার মোকাবিলা করতে হচ্ছে- সেগুলো দূতদের কাছে জানতে চান।

একজন দূত বলেন, সরকারের সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয় কমিউনিটি ভিত্তিক চাহিদা নিয়ে। যেমন একদল বলে ছবি উঠাও, আরেক দল বলে ছবি নামাও। 

উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, এক্ষেত্রে সব সময় আমরা আইনকে মান্য করবো। সরকার আইনের সঙ্গে কোনো সংঘাতে যেতে চায় না।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) নিযুক্ত বাংলাদেশের দূত বলেন, ইইউ আমাদের কাছে বেসিক বিষয়গুলো জানতে চেয়েছে। আমরা জানিয়েছি। ইইউর বার্তা খুব পরিষ্কার। তারা আমাদের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক এগিয়ে নেবে।

যুক্তরাজ্যের দূত বলেন, ব্রিটিশ ফরেন অফিসে আমরা বার্তা দিয়েছি। তাদের ৫/৬ জন এমপি আমাদের চিঠি দিয়েছেন। তাদের বার্তা হচ্ছে, তারা আমাদের সঙ্গে আছেন।

জাতিসংঘের দূত বলেন, তারুণ্যের শক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ। আমরা জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিশেষ বছর। আমরা নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে সকল প্রস্তুতি নিচ্ছি।

যুক্তরাষ্ট্রের দূত বলেন, সাম্প্রতিক পরিবর্তনের পর আমি স্টেট ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম। তারা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট পরিষ্কারভাবে বলেছে, তারা সমন্বয় করবে, কীভাবে তারা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে।

মালয়েশিয়ার দূত বলেন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রধান উপদেষ্টাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

সৌদি আরবের দূত বলেন, শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়ে এই দেশের আইন ভঙ্গ করে কিছু কিছু প্রবাসী বিক্ষোভ করেছেন। আমরা জানতে পেরেছি, কিছু প্রবাসী সৌদি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক আছেন এবং তাদেরকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আমি এই বিষয়ে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানতে চেয়েছি কিন্তু তারা কোনও জবাব দেয়নি। নোট ভারবালের মাধ্যমে সৌদিকে অনুরোধ করেছি যেন, তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়।

এনআই/এমএসএ