হাতে লাঠি, মুখে বাঁশি। মোড়ে মোড়ে যানবাহন সামলাতে দায়িত্ব পালন করছেন শিক্ষার্থীরা। আরোহী কিংবা চালক কারও হেলমেট না থাকলে আটকে দেওয়া হচ্ছে মোটরসাইকেল। তাদের কাউকে কাউকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। আবার কাউকে ৫ মিনিট কিংবা ১০ মিনিট দাঁড় করিয়ে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বাস কিংবা টেম্পুকে দাঁড় করানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা গাড়িতে থাকা যাত্রীদের জিজ্ঞেস করছেন, চালক-হেলপাররা ভাড়া বেশি নিচ্ছেন কি-না। অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করা হচ্ছে চালকদের।

মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) থেকে চট্টগ্রামের সড়কের দৃশ্য এমনই। শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে নগরের ট্রাফিক বিভাগ। প্রশিক্ষিত কেউ না হলেও শিক্ষার্থীদের আন্তরিকতা এবং কঠোরভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে সড়কে তেমন বিশৃঙ্খলা নেই বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) দুপুরে নগরের বাকলিয়া সংযোগ সড়কে অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। যদিও এ মোড়ে সচরাচর ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় না।

কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করে দেখা যায়, আরোহীদের একজনের হেলমেট না থাকায় একটি মোটরসাইকেলকে ফেরত পাঠানো হয়। ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোকে একলাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। লাইন ভেঙে কেউ অগ্রসর হতে চাইলেই আটকে দেওয়া হচ্ছে। মোড়ের একপাশে আরেকদল শিক্ষার্থী বাস ও টেম্পুকে থামাচ্ছেন। এরপর গাড়িতে থাকা যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে কি না যাচাই করছেন। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা গাড়িচালকদের নির্ধারিত গন্তব্য পর্যন্ত যাওয়ার পরামর্শ দেন।

সেখান থেকে একটু সামনে এগুতে সাবএরিয়া এলাকায় দেখা যায়, একদল শিক্ষার্থী সড়ক পরিষ্কার করছেন। বাজারে পড়ে থাকা আবর্জনাও তারা যত্নসহকারে পরিষ্কার করছেন। সেগুলো পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে আন্দরকিল্লা মোড়ে গেলেই আরেকদল শিক্ষার্থীকে যানবাহন সামলাতে দেখা যায়।

আবার নগরের জামালখান, কাজির দেউরি ও আশকারদিঘীর পাড় এলাকায় সড়কের পাশের দেয়ালগুলোতে তুলি নিয়ে রং করতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। যেখানে ফুটে উঠছে সাম্প্রতিক ছাত্রজনতার আন্দোলনের নানা ঘটনাপ্রবাহ। লালখান বাজার এলাকায় একটি দেয়ালে ছাত্রীরা বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকার পাশাপাশি লেখেন, 'জেগেছেরে জেগেছে, বীর বাঙালি জেগেছে।'

সড়ক পরিষ্কারের দায়িত্ব পালনকারী খোরশেদ আলম রানা নামে চট্টগ্রাম কলেজের এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সোমবার (৫ আগস্ট) থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা তাদের যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। একারণে সড়কে ময়লা জমেছে। আমরা সেগুলো পরিষ্কার করছি। শিক্ষার্থীদের খুনের দায়ে আমরা আন্দোলন করে সরকার পতন করেছি। এখন দেশটা গোছাতে হবে।

ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনকারী শাহরিয়ার ইফতি নামে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়কে পুলিশ নেই। তাই বিশৃঙ্খলা না হওয়ার জন্য আমরা দায়িত্ব পালন করেছি।

কীভাবে দায়িত্ব পালন করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বন্ধুরা অনলাইনে গ্রুপ খুলে দায়িত্ব ভাগ করে নিই। এরপর সড়কে দায়িত্ব পালন করি। যতদিন পুলিশ কাজ শুরু না করে, ততদিন আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে দায়িত্ব পালন করব।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট দিদার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়কের এখনকার দৃশ্য একেবারেই ভিন্নরকম। শিক্ষার্থীরা এখন কড়াকড়ি করে দায়িত্ব পালন করছেন। আবার জনবল কম ছিল বিধায় অনেক মোড়ে ট্রাফিক পুলিশকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যেত না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মোড়েও দায়িত্ব পালন করছেন। তারা যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রশিক্ষণ নেয়নি। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম আর আন্তরিকতা নিয়ে তারা কাজ করছে। তাদের দেখে অনেকেই নিজে থেকে এখন বিবেকের তাড়নায় ট্রাফিক আইন মেনে চলছেন। সবমিলিয়ে বর্তমানে সড়কে বিশৃঙ্খলা নেই বললেই চলে।

এদিকে, শিক্ষার্থীদের গুরু দায়িত্ব পালন করতে দেখে অনেকেই পাশে থেকে তাদের উৎসাহও দিচ্ছেন। কেউ কেউ তাদের আপ্যায়নও করাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে সড়কে নগরের কাজির দেউরি এলাকায় অর্ধশত শিক্ষার্থীদের বিকেলের নাস্তা করান সাংবাদিক জমির উদ্দিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়কে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে শিক্ষার্থীরা যানবাহন সামলাচ্ছেন। স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষার্থীদের এমন কাজে অভিভূত আমরা সবাই। দেশ গঠনে তাদের এমন প্রচেষ্টায় সামর্থ্য অনুযায়ী পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। সামনেও থাকার চেষ্টা করব।

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রজনতার প্রতিরোধের মুখে সোমবার (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এদিন রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে বোন শেখ রেহেনাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে উড়াল দেন তিনি।

এমআর/এসকেডি