কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে চট্টগ্রামে ৯ জন নিহত হন। আহত হন কয়েকশ ছাত্রজনতা। নগরের ছাত্রজনতার ওপর হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন মহানগর ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও সরব ছিলেন তিনি। শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ করে নানা মন্তব্য করেছেন। নানা উসকানিমূলক স্ট্যাটাস দিয়ে ক্যাডার বাহিনী নিয়ে মাঠেও নামেন। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নির্বিচারে গুলি করেছেন ছাত্রজনতার ওপর।

রনির পাশাপাশি চট্টগ্রামে ছাত্রজনতার ওপর গুলিবর্ষণে নেতৃত্ব দেন বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর বাবর। একাধিক ব্যক্তি খুনের মামলার আসামি বাবর তার দলবল নিয়ে কোটা আন্দোলন ঠেকাতে মাঠে নেমেছিলেন। এ ছাড়া, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন ও তার ক্যাডাররা কোটা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া ও গুলি করেছেন।

কোটা আন্দোলন ঘিরে হামলার ঘটনায় সহিংসতায় নেতৃত্ব দেওয়া এই তিনজনসহ অনেকেই আত্মগোপনে। তাদের অবস্থান জানেন না কেউ। বর্তমানে কেউ নিজ বাসাবাড়িতে অবস্থান করছেন না। পরিচিত নিকটাত্মীয়ের বাসায়ও তারা নেই বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সময়ের স্বল্পতায় এখনো কেউ দেশত্যাগ করতে পারেননি। তবে তারা সে চেষ্টায় আছেন বলে জানা যায়।

আবার আগ্নেয়াস্ত্র হাতে অন্তত ১০ গুলিবর্ষণকারীর ছবি গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের প্রায় সবাইকে শনাক্তও করতে পেরেছিল পুলিশ। কিন্তু সংস্থাটির কর্মকর্তারা এই ক্যাডারদের কাউকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনেননি। উল্টো নগরের পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও কোতোয়ালি থানায় হাজার হাজার নিরীহ শিক্ষার্থীদের আসামি করা হয়। হামলায় নেতৃত্ব এবং প্রাণহানির পর অস্ত্রধারী কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার তো দূরে থাক আসামি পর্যন্ত করেননি।

কোটা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা জানান, চট্টগ্রামে ছাত্রজনতার প্রাণহানির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী নুরুল আজিম রনি ও হেলাল আকবর বাবর। আবার তাদের মধ্যে রনি ফেসবুকে কোটা আন্দোলন নিয়ে শুরু থেকে সরব ছিলেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগকেই শিবির আখ্যা দিয়ে নানা প্ল্যাটফর্মে মন্তব্য করেন। মুখোমুখি হয়ে দমনের আহ্বান করেন। আন্দোলনকারীদের শায়েস্তার হুমকিও দেন।

গত ১৬ জুলাই নগরের ষোলশহর রেলস্টেশনে সমাবেশ ডেকেছিল শিক্ষার্থীরা। একই দিনে একই স্থানে সমাবেশ করার ঘোষণা দেন নুরুল আজিম রনি। এদিন সকাল থেকে ষোলশহর রেলস্টেশনে দলবল এবং ক্যাডারদের নিয়ে অবস্থান নেন রনি। একপর্যায়ে হেলাল আকবর বাবর সেখানে যান। উভয়ের মহড়ার কারণে সংঘাত এড়াতে শিক্ষার্থীরা সমাবেশ করেন মুরাদপুর এলাকায়। এ খবর পেয়ে রনি ও বাবর তাদের দলবল ক্যাডারদের নিয়ে ষোলশহর থেকে মুরাদপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়। তারা শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি পৌঁছালে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।

এ সময় আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করেন যুবলীগের জাফর, ফিরোজ, মিঠু ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের দেলোয়ার। ফিরোজ বাদে এরা যুবলীগের সাবেক নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনির অনুসারী বলে পরিচিত। অস্ত্রধারীদের মধ্যে বাবরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাফর ঘটনার দিন প্রাইভেটকার নিয়ে ষোলোশহর এলাকায় অবস্থান করছিলেন। বাবর-রনির অন্যান্য অনুসারীরা তখন গাড়ি থেকে অস্ত্র ও গুলি নামিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন। ওইদিনের ঘটনায় প্রাণ যায় ৩ জনের। তারা হলেন- চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ওয়াসিম আকরাম, মুরাদপুরের ফার্নিচার দোকানের কর্মী মোহাম্মদ ফারুক ও কলেজছাত্র ফয়সাল আহমদ শান্ত।

এ ঘটনার একদিন পর অর্থাৎ ১৮ জুলাই সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা দেন বিক্ষোভকারীরা। এদিন বিকেলে নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের তুমুল সংঘর্ষ হয়। এতে প্রাণ হারান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র বড়ুয়াসহ তিনজন। এ ছাড়া, ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটে। এদিন পুলিশ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা সড়কবাতি বন্ধ করে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালান। এতে মো. শহীদ নামে একজন দোকান কর্মচারী নিহত হন।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের একদিন আগে অর্থাৎ ৪ আগস্ট চট্টগ্রামে তুমুল আন্দোলন হচ্ছিল। সড়কে নেমে আসে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রী, তাদের অভিভাবকসহ সর্বস্তরের জনতা। ওইদিন রাজপথে শক্তি প্রয়োগ করে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এদিন শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল জামালখান মোড় থেকে কাজির দেউরি মোড়ের দিকে যাওয়ার পথে হামলা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। 

হামলায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জামালখান ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন। সেদিন তার পাশে একজন হেলমেট পরিহিত অবস্থায় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা যায়। একই মিছিলে আরেকজনকে কোমরে গুঁজে রাখা অস্ত্র বের করতে দেখা যায়। সেই দল থেকে মুহুর্মুহু গুলি করা হয় শিক্ষার্থীদের ওপর। এছাড়া ওইদিন নগরের নিউমার্কেট মোড়ে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কয়েকজন। তাদের মধ্যে এক যুবকের ছবি পাওয়া গেছে। তবে তার পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।

ছাত্রজনতার প্রতিরোধের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এদিন রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে বোন শেখ রেহেনাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে উড়াল দেন তিনি। সোমবার দুপুরে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রামের অলিগলি থেকে প্রধান সড়কে নেমে আসে মানুষজন।

এদিন একপর্যায়ে একটা মিছিল থেকে নগরের কোতোয়ালি থানার লালদিঘী এলাকায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে হামলার চেষ্টা করা হয়। এ সময় কারাগার থেকে গুলি করা হলে নিজাম উদ্দিন নামে একজন মারা যান এবং হাটহাজারী থানা এলাকায় সহিংসতার ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মো. জামাল উদ্দিন নামে একজন মারা যান।

চট্টগ্রামে সহিংসতার বিষয়ে নগর পুলিশের এক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বলেন, চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলন আমরা ভালোভাবে সামাল দিয়ে যাচ্ছিলাম। শিক্ষার্থীরা আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করে আন্দোলন করছিলেন। গত ১৬ জুলাই নুরুল আজিম রনি ও হেলাল আকবর বাবরের বাড়াবাড়ির কারণে প্রথম সংঘর্ষ হয়। তাদের অনুসারীদের গুলিতে কয়েকজনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকেই নিয়মিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, আমাদের পুলিশের অভ্যন্তরীণভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা না পাওয়ায় তাদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। ১৬ তারিখ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে রনি ঝামেলা না করলে চট্টগ্রামে হয়ত কোনো প্রাণহানি হতো না।

চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনের শুরু থেকে ছিলেন মোক্তার উদ্দিন নামে এক শিক্ষার্থী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রনি আমাদের কথায় কথায় কটাক্ষ করতেন। তিনি আমাদের চায়ের দাওয়াতে যাওয়ার কথা বলে হুমকি দিতেন। চট্টগ্রামে প্রথম প্রাণহানি শুরু হয় তিনি এবং যুবলীগের বাবরের আক্রমণের মাধ্যমে। আমরা আগে থেকে তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের কথা শুনেনি। তারা আমাদের মেরে উল্টো সেই মামলায় আমাদের গ্রেপ্তার করেছিল। এখন জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

জানা গেছে, চট্টগ্রামে সহিংসতায় জড়িত বাবর ও রনি দুজনেই সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। তাদের মধ্যে বাবর পুলিশ ও র‍্যাবের তালিকাভুক্ত চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী। বিশেষ করে রেলের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের জন্য আলোচিত তিনি। রেলের কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ে নিয়ন্ত্রণের জেরে ২০১৩ সালের ২৪ জুন বাবর এবং সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে হয়। এতে এক শিশুসহ দুজন নিহত হয়। এই জোড়া খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্যপদ থেকে হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরকে বহিষ্কার করা হয়। 

বাবরের বিরুদ্ধে রাউজানের আকবর-মুরাদ হত্যা, বিএনপিকর্মী আজাদ হত্যা, মির্জা লেনে ডাবল মার্ডার, সিটি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা আশিককে গোলপাহাড় মোড়ে হত্যা, তামাকুমুণ্ডি লেনে রাসেল হত্যা, এমইএস কলেজ থেকে ফরিদ নামের একজনকে ডেকে নিয়ে ষোলশহর ২ নম্বর গেটে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালের ১৩ই অক্টোবর র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সন্ত্রাসী অসীম রায় বাবু নিহত হওয়ার পরই দুবাই চলে যান বাবর। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশে ফিরে আসেন। ২০১৯ সালের ২৯শে মে রাতে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী খুন হলে বাবর আবার দুবাই চলে যান। শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের ছায়ায় কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে আবার রাজনীতি শুরু করেন তিনি।

এ ছাড়া, উগ্র মেজাজের লোক হিসেবে পরিচিত বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনি। ২০১৬ সালের ৭ মে মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একটি কেন্দ্রের পাশে অস্ত্র, গুলি ও ব্যালট পেপারে ব্যবহৃত সিলসহ রনিকে আটক করে বিজিবি। তার বিরুদ্ধে কলেজের অধ্যক্ষ ও কোচিং সেন্টারের পরিচালককে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন রনি। যদি তার দাবি তাকে বহিষ্কার করা হয়নি। তিনি নিজে থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।

এমআর/এমজে