কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা চরমভাবে ভেঙে পড়ে। বিশেষ করে ১৮-২০ জুলাই ঢাকার বাড্ডা, রামপুরা, বনানী, মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় রীতিমতো চলে ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলা। বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ভবন, সেতু ভবন, মেট্রোরেল স্টেশনসহ অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। এছাড়া অগ্নিসংযোগ করা হয় পুলিশের গাড়িসহ অনেক ব্যক্তিগত যানবাহনে।

এমন অবস্থায় রাজধানীতে সৃষ্টি হয় ভীতিকর এক অবস্থা। ভেঙে পড়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। মানুষ ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পেতেন না। শ্রমজীবী মানুষসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভোগান্তি চলে যায় চরম পর্যায়ে। তখন বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে সরকার যেন দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

এই ভীতিকর অবস্থা ও নৈরাজ্য বন্ধ করে শান্তি ফেরাতে গত ১৯ জুলাই মধ্য রাত থেকে সারা দেশে জারি করা হয় কারফিউ। পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য ঢাকাসহ সারা দেশে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। সেনা মোতায়েনের পর সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। দেশে আর কোনো সহিংসতারা ঘটনা ঘটেনি। সেনা সদস্যদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও কর্মদক্ষতায় রাজধানীতে জনজীবনে এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। সহিংসতায় বন্ধ হয়ে যাওয়া অর্থনীতির চাকা আবারও সচল হতে থাকে।

রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোটা আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে রাজধানীর জনজীবন স্বাভাবিক হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তারা। তাদের কাছে মনে হয়েছিল দ্রুত হয়ত এই সহিংসতার পরিবেশের উন্নতি হবে না। তবে জাতির এই দুঃসময়ে ত্রাণকর্তা হয়ে মাঠে নামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে রাজধানীসহ সারা দেশের পরিস্থিতি।

১৮-২০ জুলাই রাজধানীর রামপুরা এলাকায় চলা তাণ্ডবের প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দা মো. ইমতিয়াজ বলেন, এই তিন দিন রামপুরা এলাকায় রীতিমতো ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে। বাসার ছাদ থেকে বিটিভি ভবন জ্বলতে দেখেছি। এই কয়েকদিন ভয়ে রাস্তায় বের হওয়ার চিন্তাও করতে পারেনি। বাসায় পরিবার নিয়ে ছিলাম সেখানেও আতঙ্কে ছিলাম যে, কখন কি হয়ে যায়। রামপুরায় আমার একটি জুতার দোকান আছে। ওই সময়ে ভয়ে দোকানও খুলতে পারছিলাম না, ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলাম। এর মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। এখন কারফিউ শিথিলের সময় স্বাভাবিক সময়ের মতো ব্যবসা করতে পারছি। সেনাবাহিনী মাঠে আছে, তাই আর কোনো ভয় লাগে না।

রাজধানীর বনানী এলাকার রিকশা চালক মানিক মিয়া সহিংসতার ঘটনা ও সেনাবাহিনী মোতায়েনের পরবর্তী অবস্থা নিয়ে বলেন, ‘সেতু ভবনে যখন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় তখন একটু দূরেই ছিলাম। কোনোমতে রিকশাটা নিয়ে প্রাণে বেঁচে ফিরেছি। যে কয়েকদিন এই সহিংসতার ঘটনা চলেছে আমাদের তো কাম কাজ সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমরা গরিব মানুষ একদিন রিকশা না চালাইলে আমাদের সংসার চলে না। টানা কয়েকদিন এই অচল অবস্থা থাকার কারণে পরিবার নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলাম। যখন সরকার সেনাবাহিনী নামাইছে তখন থেকে অবস্থা আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকে। সেনাবাহিনীর নামার পর আমিও রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। যখন কারফিউ থাকে না তখন রিকশা চালাই। সেনাবাহিনী রাস্তায় থাকায় এখন আর কোনো ঝামেলা হয় না। সাহসের সঙ্গে রিকশা চালাইতে পারতেছি। যা টাকা আয় হইতেছে তা দিয়ে সংসার চালাইয়া ভালোই আছি।’

এদিকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের আগে সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন অভিভাবকেরাও। সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর এখন অনেকটা স্বস্তি ফিরেছে। তারা বলছেন, সেনাবাহিনী মোতায়েনের আগে রাজধানীর অবস্থা ছিল ভয়াবহ। ছেলেমেয়েদের বাসায় অনেক সময় আটকে রাখা যেত না। সে সময়গুলোতে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় শঙ্কিত থাকতেন তারা। কেননা এই সহিংসতার সময় বিভিন্ন খবর তাদেরকে আরও বিচলিত করে তুলতো। তবে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরে আসে রাজধানীতে। আর কোথাও সহিংসতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। ফলে সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেকটা স্বস্তিতে অভিভাবকেরা।

এ বিষয়ে রাজধানীর বাড্ডায় এলাকার অভিভাবক মোছা. কামরুন নাহার বলেন, আমার কলেজ পড়ুয়া ছেলে সন্তান আছে। যখন আন্দোলন হচ্ছিল সে বিভিন্ন সময় সহপাঠীদের ডাকে বের হয়ে যেত, আটকাতে পারতাম না। সেই সময়টাতে বিশেষ করে বাড্ডা এলাকায় চলছিল ভয়াবহ ঘটনা ও তাণ্ডব। পরিস্থিতি ছিল একদম নিয়ন্ত্রণহীন। এসব ঘটনার কারণে ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে কলিজায় পানি থাকতো না। কিন্তু সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর বাড্ডাসহ সারা রাজধানীর পরিবেশ শান্ত হয়ে আসে। তখন আমাদের অভিভাবকদের মনেও প্রশান্তি আসে। এখন ছেলে রাস্তায় কোনো কাজে গেলে আর ভয় হয় না তেমন। মনে এইটুকু বিশ্বাস আছে সেনাবাহিনী যেহেতু রাস্তায় আছে তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না। কারফিউ শিথিল সময় আমিও মাঝেমধ্যে বের হই।

এদিকে গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, কারফিউ শিথিলের পর রাজধানীর প্রায় সব এলাকা হয়ে উঠেছে কর্মচঞ্চল। স্বাভাবিক সময়ের মতো চলতে থাকে রাজধানীবাসীর কাজকর্ম। কারফিউ শিথিলের সময় রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে থাকে যানবাহনের লম্বা লাইন। বিশেষ করে রাজধানীর বাড্ডা-রামপুরা রোড, বিজয় সরণি, কারওয়ান বাজার, মিরপুর ও পল্টন-গুলিস্তান এলাকায় থাকে যানবাহনের চাপ।

কারফিউ শিথিলের সময় ব্যাংক-বিমা থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শপিংমল, রেস্তোরাঁ, ফুটপাতের সব ধরনের দোকানপাট খোলা থাকে । ফুটপাতের খাবারের দোকান থেকে শুরু করে পোশাকসহ নানা পসরা নিয়ে বসেন বিক্রেতারা।

জানা যায়, দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর সেনাবাহিনী মোতায়েনে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানা।

এদিকে, মতিঝিল ও সচিবালয়ে অফিস করতে যাওয়া অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানান যায়, সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর মতিঝিল ব্যাংক পাড়া ও সচিবালয় এলাকায় জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক। মতিঝিল এলাকার ব্যাংক পাড়ায় মানুষের মধ্যে ব্যাপক কর্ম-চঞ্চলতা দেখা গেছে। কোথাও কোনো ভীতিকর অবস্থা নেই। সচিবালয়ও রয়েছে কর্মমুখর।

আরও জানা যায়, সহিংসতা ও তাণ্ডবের কারণে ব্যাংক বিমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম স্থবির হয়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে। প্রাণ ফিরে পায় মতিঝিলের ব্যাংক পাড়া।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় রাজধানীর বেশ কয়েকটি সিনেমা হল চালু করা হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সসহ আরও বেশ কয়েকটি অভিজাত সিনেমা হল খুলে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে কারফিউ চলাকালীন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর অনেক বাসিন্দা ও তরুণরা কারফিউর আইন সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানেন না। তাই তারা মাঝেমধ্যে কারফিউর মধ্যেও চলাফেরা করছেন। তবে সে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী অনেক মানবিক আচরণ করছে। কারফিউর মধ্যে কোথাও সেনা সদস্যরা কাউকে হয়রানি করেছেন বলে এমন অভিযোগ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। রাজধানীতে সেনা সদস্যরা অনেক আন্তরিক ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

এছাড়া কারফিউ চলাকালীন রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সেনাবাহিনী তল্লাশিচৌকি (চেকপোস্ট) কার্যকর রেখেছে। প্রয়োজন অনুসারে টহল এবং ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’র আওতায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী।

এমএসি/এমএ