দলবলসহ বদলি ওসি, নেপথ্যে গুরুতর যেসব অভিযোগ
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রিটন সরকার ও তার সহযোগী চার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও এক সহকারী উপ-পরিদর্শককে (এএসআই) সম্প্রতি একযোগে বদলি করা হয়েছে। দলবলসহ এক থানার ওসির এমন বদলির নেপথ্যে অভিযোগের পাহাড়।
এর মধ্যে গুরুতর অভিযোগ- অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো, কিশোর গ্যাং প্রশ্রয় দেওয়া এবং হত্যা মামলা না নেওয়া।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি চট্টগ্রাম রেঞ্জ ও জেলা পুলিশ পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে তাদের বদলি করে। এর মধ্যে ওসি প্রিটন সরকারকে পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে বদলি করা হয়। গত ২৮ জুলাই বদলির আদেশে সই করেন চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) নুরে আলম মিনা।
এরপর ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহর সই করা এক আদেশে সাতকানিয়ায় কর্মরত এসআই মোস্তাক আহমদ ও রাজু আহমেদকে খাগড়াছড়ি, এসআই আবদুর রবকে রাঙ্গামাটি, এসআই আলাউদ্দিনকে বান্দরবান এবং এএসআই জহিরুল ইসলামকে কক্সবাজার জেলায় বদলি করা হয়।
আরও পড়ুন
আদেশে এসআই মোস্তাক আহমদ আবদুর রব ও আলাউদ্দিনকে প্রশাসনিক কারণে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে চট্টগ্রাাম রেঞ্জে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমানকে জনস্বার্থে সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) পদে পদায়ন করা হয়।
জানা গেছে, সাতকানিয়ায় কর্মরতকালীন সময়ে ওসি প্রিটন সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক গুরুতর অভিযোগ ওঠে। এলাকায় একাধিক খুনের ঘটনা ঘটলেও পুলিশকে নির্বিকার দেখা যায়। কিশোর গ্যাংয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন এলাকাবাসী।
অভিযোগ রয়েছে, খুনের শিকার দিনমজুরের পরিবার আকুতি জানিয়ে অন্তত দুদিন থানায় গেছে। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের চাপের কথা জানিয়ে মামলা নিতে রাজি হয়নি পুলিশ। পরে শর্ত দেওয়া হয়, ঘটনায় মূল অভিযুক্ত এক ছাত্রলীগ নেতা ও তার অনুসারীদের নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ দিলে মামলা নেওয়া হবে। এতে নিহতের পরিবার রাজি হননি।
গত ২১ জুন সাতকানিয়ার কেরানিহাটে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম চৌধুরী সাতকানিয়া থানার ওসিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ১৫ দিনের মধ্যে সাতকানিয়াকে কিশোর গ্যাং ও মাদক মুক্ত করতে হবে। তা না পারলে সাতকানিয়ায় আপনাদের থাকার দরকার নেই। আপনারা কেন, কী কারণে, কোন উদ্দেশ্যে, কার কথায় কিশোর গ্যাং ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না?
একের পর এক খুনের ঘটনা
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি সাতকানিয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা থেকে মো. শাহাবুদ্দিন (৩৫) নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গত ২৮ মে উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নের মিঠার দোকান এলাকায় ছুরিকাঘাতে মোহাম্মদুল হক (৩৩) নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে খুন করা হয়। এছাড়া ২৯ মে রাত ৮টার দিকে সাতকানিয়ার আমিলাইশ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ আমিলাইশে মো. মহিউদ্দিন (২৫) নামে এক পিকআপচালককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এছাড়াও পূর্ব বিরোধে গত ৯ জুন সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় ফজল আহমদ (৫৫) নামের এক কৃষককে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
থানায় হত্যা মামলা রেকর্ড হয়নি!
ছদাহা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ কর্মী দিনমজুর মোহাম্মদুল হক খুন হন দিনদুপুরে। ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড মিঠার দোকান এলাকার জনসম্মুখে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সাতকানিয়া থানায় মামলা নেওয়া হয়নি। ঘটনার দিন রাত ১০টা পর্যন্ত নিহতের স্বজনদের থানায় বসিয়ে রেখে বিদায় করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, খুনের শিকার দিনমজুরের পরিবার আকুতি জানিয়ে অন্তত দুদিন থানায় গেছে। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের চাপের কথা জানিয়ে মামলা নিতে রাজি হয়নি পুলিশ। পরে শর্ত দেওয়া হয়, ঘটনায় মূল অভিযুক্ত এক ছাত্রলীগ নেতা ও তার অনুসারীদের নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ দিলে মামলা নেওয়া হবে। এতে নিহতের পরিবার রাজি হননি। আর মামলাও রেকর্ড হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঘটনার ৫ দিন পরও থানায় মামলা না নেওয়ায় গত ৩ জুন চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন নিহত মোহাম্মদুল হকের বড় ভাই এনামুল হক (৪১)। পরে আদালত সাতকানিয়া থানার ওসিকে ফৌজদারি অভিযোগটি নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেন।
পুলিশের যোগসাজশে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ
উপজেলার চরতী ইউনিয়নে ১৮ জুন আতিক নামে এক গাড়িচালকে বেধড়ক মারধর করা হয়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ভাঙা বন্দুক দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে সন্ত্রাসীরা। পরে পুলিশ হেফাজতে আতিককে ভর্তি করানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। স্থানীয়দের কাছে এই সন্ত্রাসীরা ‘সাইফুল বাহিনী’ নামে পরিচিত।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সব জেনেও পুলিশ সন্ত্রাসীচক্রের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো সাধারণ মানুষকে বন্দুক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। সাইফুল কিশোর গ্যাং নিয়ে অস্ত্রের মহড়া দিলেও ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।
এছাড়া গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সাতকানিয়া থানার ঢেমশা ইউনিয়নের মাইজপাড়ার বিলে ক্রিকেট খেলার সময় তানভীর হোসেন তুর্কি নামে এক যুবককে আটক করে পুলিশ। পরে তাকেও অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো ও থানা হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ আনে তার পরিবার।
এমআর/এমএসএ