কোটা আন্দোলন সংস্কারের দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) প্রথমে সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর গেট এলাকায় সড়ক অবরোধ। ধাপে ধাপে চট্টগ্রাম শহরমুখী হতে থাকে আন্দোলন। একপর্যায়ে সমাবেশ ডাকা হয় নগরের পাঁচলাইশ থানার ষোলশহর এলাকায়। এরপর শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। এতে অন্তত ছয়জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়। গুরুতর আহত ও গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী।

১ জুলাই

কোটা সংস্কার এবং ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সমাবেশ করে চবি শিক্ষার্থীরা। ১ জুলাই বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সমাবেশে শিক্ষার্থীরা চার দফা দাবি পেশ করেন।

৩ জুলাই

চবি শিক্ষার্থীরা হাটহাজারী-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এতে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট তৈরি হয়। ৩ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে সমাবেশটি শুরু হয়ে জিরো পয়েন্ট অতিক্রম করে হাটহাজারী-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা।

৪ জুলাই

কোটা সংস্কারের দাবিতে ৪ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে প্রায় পাঁচশ শিক্ষার্থী উপস্থিত হয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।

৬ জুলাই

এদিন ক্যাম্পাস ছেড়ে শহরে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তারা বিকেল পৌনে ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চট্টগ্রামের ২ নম্বর গেট অবরোধ করেন।

৮ জুলাই

কোটা সংস্কারের দাবিতে রেলপথ অবরোধ করেন চবি শিক্ষার্থীরা। এতে ঢাকা-কক্সবাজারগামী পর্যটন এক্সপ্রেস ট্রেন আটকা পড়ে। বিকেল ৪টার দিকে ষোলশহর রেলস্টেশনে এ কর্মসূচি পালন করেন তারা। আধা ঘণ্টা পর রেলপথ অবরোধ তুলে নিলে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়।

একই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় তালাত মাহমুদ রাফি নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এক শিক্ষার্থীকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ভুক্তভোগীর বাবার নম্বরে কল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ হুমকি দেন বলে জানা যায়। তালাত মাহমুদ রাফি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অভিযুক্ত শিক্ষার্থী হৃদয় আহমেদ রিজভী একই বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় রাফি প্রক্টর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন।

৯ জুলাই

এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। পরে দুপুর ১২টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেন তারা।

১০ জুলাই

কোটা সংস্কার করার এক দফা দাবিতে নগরের দেওয়ানহাট এলাকায় রেলপথ অবরোধ করেন চবি ও চবি অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফলে চট্টগ্রাম-ঢাকা ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একই দিন শিক্ষার্থীরা নগরের টাইগারপাস এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন।

১১ জুলাই

এদিন পুনরায় টাইগারপাস এলাকায় সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশ সেখানে বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে দুই শিক্ষার্থী আহত হন।

১২ জুলাই

এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এদিন বিকেল ৫টার দিকে ষোলশহর রেলস্টেশন এলাকায় মিছিল শুরু হয়। এরপর ২ নম্বর গেটে আসেন শিক্ষার্থীরা। ওইদিন কর্মসূচিতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকেল ৪টার শাটল ট্রেনে চড়ে ১৬ কিলোমিটার দূরে ষোলশহর স্টেশনে যান শিক্ষার্থীরা।

১৪ জুলাই

কোটা বৈষম্য নিরসন করে সংসদে আইন পাসের লক্ষ্যে জরুরি অধিবেশন আহ্বান ও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গণ-পদযাত্রার পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেন চবি, চট্টগ্রামের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও চবি অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এদিন দুপুর ১টার দিকে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আব্দুল মালেক বরাবর এ স্মারকলিপি দেয়।

১৫ জুলাই

চবিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। ক্যাম্পাসে প্রক্টরের অফিসের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের উত্তেজনার মধ্যে তিনটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে প্রাঙ্গণে চবি শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক আইন সম্পাদক খালিদ হোসেনের নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ। খান তালাত মাহমুদকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধরে নিয়ে গেছেন– এমন খবর শুনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট থেকে মিছিল নিয়ে প্রক্টর কার্যালয়ের দিকে আসছিলেন। এসময়ে মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারের সামনে এলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করেন। এতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমানের মাথা ফেটে যায়।

১৬ জুলাই

আগের দিন কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভের ডাক দেন সমন্বয়করা। চট্টগ্রামে এদিন বিক্ষোভের স্থান নির্ধারণ করা হয় ষোলশহর রেলস্টেশন। ওইদিন দুপুর ১টা থেকে ষোলশহর এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। তাদের হাতে ছিল লাঠিসোঁটা, পাথর। কোটা আন্দোলনকারীরা ষোলশহরে অবস্থান নিতে না পেরে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় জড়ো হন। দুপুর ২টা থেকে বাড়তে থাকে তাদের জমায়েত। আন্দোলনকারীরা মুরাদপুরের সড়ক বিভাজকের লোহার রেলিং ভেঙে ফেলেন। তাদের হাতেও লাঠিসোঁটা ও পাথর ছিল।

দুপক্ষের মুখোমুখি অবস্থানে চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, চলে পাথর নিক্ষেপ। এসময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। ওইদিনের সংঘর্ষে চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষার্থীসহ তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

১৭ জুলাই

সংঘর্ষে আন্দোলনকারীদের তিনজনের মৃত্যুর পর এদিন আর সেভাবে আন্দোলন হয়নি। তবে আগের দিন নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় নগরীর লালদিঘি মাঠে। ওইদিন পুলিশি অ্যাকশন শুরু হয়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। নগর ছাত্রদলের সদস্য সচিব শরিফুল ইসলাম তুহিনসহ একাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৬ জুলাই দিবাগত রাত ও ১৭ জুলাই চারটি মামলা দায়ের হয়। এতে আসামি করা হয় কয়েক হাজার ব্যক্তিকে। ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে চট্টগ্রামে মোবাইল নেটওয়ার্ক কমে যায়। ওইদিন থেকে মোবাইল নেটওয়ার্ক দিয়ে ফেসবুক ও মেসেঞ্জার চালানো যায়নি।

এদিন জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে চবি প্রশাসন। ১৭ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ছাত্রী ও রাত ১০টার মধ্যে ছাত্রদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

১৮ জুলাই

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আগের দিন সারা দেশে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী ১৮ জুলাই সকাল থেকেই নগরীর অন্যতম প্রধান প্রবেশমুখ শাহ আমানত সেতু এলাকায় জড়ো হতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। মুখোমুখি অবস্থান নেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। বেলা ১১টার দিকে শুরু হয় সংঘর্ষ। পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও ফাঁকা গুলি নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেন বাকলিয়া কলেজ এলাকায়। সেখানে সড়ক অবরোধ করে তারা। সেখানেও পুলিশে গিয়ে তাদের ধাওয়া দেয়।

সেখান থেকে দুপুর ২টার দিকে আবার বহদ্দারহাট এলাকায় অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে আগে থেকেই চাঁন্দগাও আবাসিক, মেয়র গলি, বাড়াইপাড়া এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। বহদ্দারহাটে দুই পক্ষের মধ্যে চলে সংঘর্ষ। দুপুর আড়াইটার দিকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেয়। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে বাদুড়তলা ও মুরাদপুর এলাকার দিকে চলে যান। সেখান থেকে বিকেল ৪টার দিকে আবারও বহদ্দারহাটের দিকে যান আন্দোলনকারীরা। এরপর শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ। সেখানে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে গুলিবর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এদিন আন্দোলনকারীরা বহদ্দারহাটের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভবন ভাঙচুর ও পুলিশ বক্সে আগুন দেন। কমপক্ষে আটটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেন তারা। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভাতে এগিয়ে এলেও তারা আন্দোলনকারীদের বাঁধার মুখে পড়ে। এদিন সংঘর্ষে দুইজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। পরে চিকিৎসাধীন হৃদয় চন্দ্র তড়ুয়া নামে আরেক চবি শিক্ষার্থী মারা যান বলে খবর আসে।

এদিন রাত ৮টার দিকে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় বিকাশ, এটিএম বুথ থেকে টাকা লেনদেন করা যায়নি। তবে কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করা গেছে বলে জানিয়েছে গ্রাহকেরা।

১৯ জুলাই

এদিন জুমার নামাজ শেষে নগরের আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ থেকে মিছিল বের করে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। আন্দরকিল্লা-চেরাগিপাহাড়-জামালখান-কাজীর দেউড়ি হয়ে নিউমার্কেট এলাকায় মিছিল করেন তারা। এসময় কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন তারা। পরে পুলিশ টিয়ারগ্যাস ছুঁড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ছুটির দিন হলেও পুরো চট্টগ্রাম ছিল থমথমে।

মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি করা হয়। এ খবরে পুরো শহরে যান চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। দোকানপাট, অলিগলিতে শুনশান নীরবতা নেমে আসে। ওইদিন রাতে সেনা সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়নি। তবুও পুরো শহর অচল হয়ে যায়। এরপর থেকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাস্তায় তেমন কারও উপস্থিতি ছিল না। কারফিউ চলাকালে মোড়ে মোড়ে তল্লাশি করে পুলিশ। কোনো গাড়ি ও পথচারী দেখলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। ওইসময় কার্যত ঘরবন্দি হয়ে যায় নগরবাসী। কারফিউ চলাকালে সেনা টহলও দেখা যায়।

আতিকুর রহমান/এমআর/এমআরএন