কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল রাজধানী ঢাকা। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনায় অনেকের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, আহত হন অসংখ্য। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গত শুক্রবার রাতে (১৯ জুলাই) ঢাকাসহ সারা দেশে কারফিউ জারির পাশাপাশি সেনা মোতায়েন করে সরকার। পাশাপাশি দেশজুড়ে বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট সেবা।

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। বিশেষ করে ১৮ থেকে ২০ জুলাই— এই তিনদিনে সবচেয়ে বেশি হতাহত হয় এবং ৮৯টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি, সেতু ভবন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে হামলার ঘটনা ঘটে।

গত ১৮-২০ জুলাই কোটা আন্দোলনের সময় নারকীয় তাণ্ডবের ঘটনা ঘটে রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায়। এসময় আন্দোলনকারীদের মধ্যে দুষ্কৃতকারীরা ঢুকে আগুন লাগিয়ে দেয় বিটিভির মূল ভবনে। এছাড়া রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। ভাঙচুর করা হয় সরকারি-বেসরকারি গাড়ি, তারপর করা হয় অগ্নিসংযোগ। এছাড়া এই তিনদিন বাড্ডা ও রামপুরা রোড ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাহিরে।

এই সময়টাতে দুষ্কৃতকারীরা রাস্তায় স্থাপন করা সব সিসিটিভি ক্যামেরা খুলে নিয়ে যায়। রাস্তায় থাকা লোহার ডিভাইডার পর্যন্ত ভেঙে নিয়ে যায় এক শ্রেণির দুষ্কৃতকারী। এছাড়া ভাঙচুর করা হয় রাস্তার আশপাশের দোকানে।

তবে দেশে কারফিউ জারি হওয়ার পর দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো শান্ত হয়ে আসে রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা এলাকা। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করে রাজধানীর এই ব্যস্ততম এই দুই এলাকার জনজীবন।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলেও বাড্ডা ও রামপুরা এলাকায় কোটা আন্দোলনের সময় চলা তাণ্ডবের চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) ও শুক্রবার (২৬ জুলাই) রাজধানীর বাড্ডা এবং রামপুরা এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, কোটা আন্দোলনের সময় চলা তাণ্ডবে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় রামপুরা পুলিশ বক্সসহ বাড্ডা এলাকার আরও কয়েকটি পুলিশ বক্স। সেখানকার ধ্বংসাবশেষের চিত্র দেখে তাণ্ডবের ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। এছাড়া আরও দেখা যায় রামপুরা থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত লোহার ডিভাইডারগুলো উধাও। কোথাও কোথাও লোহার রোড ডিভাইডারের কিছু ভাঙা অংশ দেখা গেছে।

এছাড়া রাজধানীর উত্তর বাড্ডা থেকে নতুন বাজার এলাকা পর্যন্ত দেখা গেছে, রাস্তার পাশে থাকা বেশ কয়েকটি দোকানেও ভাঙচুর করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, কোটা আন্দোলন চলাকালীন এক শ্রেণির উঠতি বয়সের তরুণরা এই ভাঙচুর করেছে যারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী নয়।

নারকীয় তাণ্ডব নিয়ে যা বলছেন স্থানীয়রা

রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সরকারের আমলে এর আগে দেশে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি। রাস্তা দখল করে এমন তাণ্ডব তারা এর আগে কখনও দেখেননি।

তারা আরও বলছেন, গত ১৮-২০ জুলাই এই তিনদিন রামপুরা থেকে বাড্ডা পর্যন্ত সম্পূর্ণ রাস্তা ছিল নিয়ন্ত্রণহীন। তখন আন্দোলনকারীদের মধ্যে ঢুকে এক শ্রেণির দুষ্কৃতকারী রাস্তায় রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছে।

এ বিষয়ে তাণ্ডবের প্রত্যক্ষদর্শী রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মো. হামিদুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবারের আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। তখন রাস্তায় কোনও ভাঙচুর হয়নি এবং সহিংসতার ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত থেকে আন্দোলনে একশ্রেণির বহিরাগতদের দেখা যায়। যারা কিনা রাস্তায় রীতিমতো তাণ্ডব চালিয়েছে। এর আগে এমন তাণ্ডব বাড্ডা এলাকায় আমরা কখনো দেখিনি। এ সময় রাস্তায় পরিস্থিতি দেখতে অনেক সাধারণ মানুষও ছিল। আমাদের সামনেই দুষ্কৃতকারীরা রাস্তার লোহার ডিভাইডার খোলে নিয়ে যায়। গাড়িসহ রাস্তায় টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়।

রাজধানীর দক্ষিণ শাহজাদপুরের বাসিন্দা মো. মঞ্জু তাণ্ডবের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে বলেন, গত ১৮-১৯ জুলাই ভয়াবহ অবস্থা ছিল শাহজাদপুর থেকে নতুন বাজার এলাকার।  রাস্তায় একদিকে হাজার হাজার মানুষ। অন্যদিকে রাস্তায় জ্বলছিল আগুন। গুলির শব্দে ভীতিকর একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এলাকায় তখন অনেক বহিরাগত লোক দেখতে পাই, যাদের এর আগে কোনওদিন এলাকায় দেখিনি। এই দুষ্কৃতকারীরাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে তাণ্ডব চালিয়েছে। তারা হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই ভাঙচুর করেছে। জায়গায় জায়গায় অগ্নিসংযোগ করেছে।

রাজধানীর রামপুরার বাসিন্দা মফিজুল হোসেন বলেন, সেনাবাহিনী নামার পর পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। কিন্তু ওই তিনদিনের তাণ্ডবের কথা জীবনে ভুলবো না। বাসার ছাদ থেকে দেখেছি বিটিভির ভবনে আগুন। ফায়ার সার্ভিসের লোকজনও সেখানে যেতে পারেনি। চারদিকে আগুন আর গুলির শব্দ। তখন সারা রামপুরা এলাকায় ছিল আতঙ্কে। এখন তো স্বাভাবিক। কিন্তু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে ভাঙচুর হয়েছে। এসব লাইট এখন আর জ্বলে না। রাতের বেলায় অন্ধকারময় এক পরিস্থিতি বিরাজ করে। পুলিশবক্স পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এখন ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের বসার জায়গা নাই। এসব তো আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ ছিল। শিক্ষার্থীরা এসব ধ্বংস করে নাই। বৃহস্পতিবার রাতে রামপুরা এলাকায় হাজারখানেক লোক মিলে এসব তাণ্ডব চালিয়েছে, তারা কেউই শিক্ষার্থী ছিলেন না।

এমএসি/পিএইচ