> ফায়ার সার্ভিসকে ঘটনাস্থলে যেতে বাধা
> যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন
> আনুমানিক ২০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির দাবি
> তদন্ত কমিটি গঠন, প্রতিবেদন পেলে আইনি পদক্ষেপ

কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলাকালে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে আগুন দেওয়া হয়। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনটির একাধিক গাড়ি, ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন অংশ পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

ওইদিন বিকেল পৌনে ৩টায় আগুনের সূত্রপাত হলেও রাত ৯টায়ও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে ৬ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আগুনে পুড়ে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় টেলিভিশন ভবন। যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই শুধু তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন।

মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বাংলাদেশ টেলিভিশন চত্বর ঘুরে এমন ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, টেলিভিশনের ভেতরে-বাইরে সর্বত্র সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর শতাধিক সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন। টেলিভিশনের দুই গেটের বাইরে সেনাবাহিনীর তিনটি সাঁজোয়া যান এবং ভেতরের দিকে আরও চারটি সাঁজোয়া যান রাখা হয়েছে। এছাড়াও সারিবদ্ধভাবে বিজিবি, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে থাকতে দেখা গেছে।

তাছাড়া টেলিভিশনের নিরাপত্তার স্বার্থে বিটিভি ভবনের গেটের সামনে কাউকে অবস্থান বা চলাফেরা করতে দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসময় ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরতে আসা একাধিক সাংবাদিককেও টেলিভিশনের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

স্থানীয়দের বয়ানে সেদিনের ধ্বংসযজ্ঞ

রামপুরা এলাকার টিভি রোডের বাসিন্দা মো. ফখরুল ইসলাম নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বিকেল পৌনে ৩টার দিকে বিটিভিতে আক্রমণ শুরু হয়। এসময় ক্যান্টিনের সামনের একটি গাড়িতে আগুন ও ক্যান্টিন ভাঙচুর করা হয়। এসময় শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনের পক্ষে এবং বিভিন্নস্থানে গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদে নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। এরপর দলে দলে আরও শিক্ষার্থী আসতে থাকেন, স্থানীয় কিছু মানুষও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। একপর্যায়ে ভয়ে-আতঙ্কে দৌড়ে তিনি বাসায় চলে যান।

প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি থাকায় সেদিন পুলিশ অনেকটাই কোণঠাসা ছিল। পুলিশ শুরুতে গুলি করলেও একপর্যায়ে পিছু হটে এবং শিক্ষার্থীরা পুরো এলাকা দখল নেয়। এরপর সারাদিন রামপুরা এলাকায় কোনো পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনীর সদস্যরা ঢুকতে পারেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, সেদিন রামপুরায় ছাত্রদের ওপর প্রথম গুলি ছোড়া হয়। এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গুলির খবর শুনে ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়কে বের হয়ে আসার চেষ্টা করে। পরে তাদের ওপরও গুলি চালানো হয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। এরপরই স্থানীয়রা ও অন্য ছাত্ররা রামপুরার দিকে দৌড়ে আসেন। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালায়। আহত হন কয়েকজন। একপর্যায়ে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

আতঙ্কে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

বাংলাদেশ টেলিভিশনে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তারা জানান, টেলিভিশনের ভেতরে-বাইরে সর্বত্র এখনো ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেদিন ভেতরে আটকে পড়া অধিকাংশ কর্মীর মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে।

টেলিভিশনের একজন সিনিয়র রিপোর্টার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওইদিন বিটিভির অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। ভেতরে যারা আটকে পড়েছিলেন তারা খুবই আতঙ্কে ছিলেন। বিকেলের দিকে অনেকের অফিস শেষ হলেও তারা রাত ১০টায়ও অফিস থেকে বের হতে পারেননি। কেউ বের হতে চাইলেই চারদিক থেকে ইট-পাটকেল ছুটে আসছিল।

তিনি বলেন, আন্দোলনকারীরা আমাদের একাধিক ক্যামেরা ভাঙচুর করেছে। তারা আমাদের রিসিপশন, ক্যান্টিন ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। এরপর ১২তলা বিল্ডিংয়ে ঢুকে অনেক আর্কাইভ নষ্ট করে ফেলেছে। এমনকি স্টুডিওর ভেতরেও প্রবেশ করে তারা একাধিক ক্যামেরা ভাঙচুর করেছে। সবমিলিয়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

কীভাবে চলছে বাংলাদেশ টেলিভিশন?

বিটিভিতে কর্মরত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আপাতত বিশেষ নিউজগুলোর জন্য একটা টিম করা হয়েছে। তাদের দিয়েই নিউজ চালানো হচ্ছে। এছাড়াও একটি-দুটি গাড়ি রাখা হয়েছে, যেগুলো দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকলে কাভার করা হচ্ছে। আর বাকি সব অন্য টেলিভিশন চ্যানেল থেকে রেকর্ড করে চালানো হচ্ছে।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিটিভির পক্ষ থেকে একটি, অন্যটি তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়েছে। তারা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করছে। যে কারণে মূল ক্ষয়ক্ষতিটা আপাতত বলা যাচ্ছে না।

প্রতিষ্ঠানটির এক নারী কর্মী বলেন, আমাদের বলা হয়েছে অন্য টেলিভিশন থেকে আপাতত খবরগুলো সংগ্রহ করতে। বিটিভির একটি সুবিধা হলো তারা মেয়েদের খুব বেশি রিস্কের মধ্যে ফেলতে চায় না। বিটিভির একেবারে কাছে যাদের বাসা, তাদের দিয়েই কাজ করানো হচ্ছে।

কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি, তদন্ত কমিটি গঠন

এদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক (ডিজি) ড. জাহাঙ্গীর আলম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করা যায়নি। তবে আমরা ধারণা করছি কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। তারা (আন্দোলনকারীরা) বিটিভির কেন্দ্রে আগুন দিয়েছে, ক্যামেরাসহ অনেক কিছুই পুড়িয়ে দিয়েছে। অনেক যন্ত্রপাতি লুটপাটও করেছে। নির্দিষ্ট করে ক্ষতির পরিমাণ বের করতে হলে আমাকে তালিকা করতে হবে।

তিনি বলেন, আন্দোলনকারীরা আমাদের ১৭টি গাড়ি পুড়িয়েছে, ৯টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে, দুটি সম্প্রচার ভ্যান পুড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়াও আগুনে বিল্ডিংয়ের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবমিলিয়ে ভয়াবহ একটা হামলা ও অগ্নিকাণ্ড বিটিভিতে হয়েছে, যেই পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে তুলে ধরাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা সম্প্রচার কার্যক্রম আবারও শুরু করেছি। আগুনের পরদিনই আমরা সম্প্রচার পুনরুদ্ধার করেছি। এখনো আমরা নতুন অনুষ্ঠান বানাতে পারছি না, তবে পুরোনো অনুষ্ঠানগুলো দিয়েই আমরা সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

আইনি ব্যবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের তদন্ত কমিটিকে ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তারা এসময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।

টিআই/এসএসএইচ