সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের প‌রি‌প্রেক্ষি‌তে বাংলা‌দে‌শে অবস্থানরত মা‌র্কিন নাগরিকদের চলাচলে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।

সোমবার (১৫ জুলাই) তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সতর্কবার্তায় দূতাবাস বলেছে, সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ বিস্তৃত হয়ে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা এবং অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। 

পরিস্থিতি ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এই ধরনের বিক্ষোভ স্থানীয় পরিবহন পরিষেবাগুলো‌কে প্রভাবিত করতে পারে এবং ঢাকায় আসা-যাওয়া কঠিন হ‌তে পা‌রে।

সতর্কবার্তায় দূতাবাস আরও বলেছে, মার্কিন নাগরিকদের সতর্কতা অনুশীলন করা উচিত এবং মনে রাখা উচিত যে বিক্ষোভ সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে। সহিংসতায় পরিণত হতে পারে। সেজন্য বি‌ক্ষোভ এ‌ড়ি‌য়ে চলার পাশাপা‌শি কোনো বড় সমাবেশের আশেপাশে থাক‌লে সতর্কতা অবলম্বন করুন। 

ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় ঘটনাসহ মা‌র্কিন নাগ‌রিক‌দের সচেতন থাকা এবং স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শ দি‌য়ে‌ছে মা‌র্কিন দূতাবাস।

উল্লেখ্য, ১৪ জুলাই চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে করা এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরা কিছুই পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা সব পাবে?’

প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি’ বলা হয়েছে অভিযোগ করে রোববার রাত থেকে প্রতিবাদ শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাতে প্রথমে রোকেয়া হলের মেয়ে শিক্ষার্থীরা হল থেকে মিছিল নিয়ে বের হয়ে আসেন। তারা স্লোগান দেওয়া শুরু করেন ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল থেকে ছেলে ও মেয়ে শিক্ষার্থীরা দলে দলে মিছিল নিয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে এসে বিক্ষোভ শুরু করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টার বিক্ষোভ শেষে হলে ফিরে যান তারা।

একই সময়ে মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

একই ইস্যুতে গতকাল সোমবার উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাবিসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। দুপুরের দিকে ঢাবির রাজু ভাস্কর্যে এসে অবস্থান নেন কয়েকশ আন্দোলনকারী। এসময় তারা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার চেয়ে নানা স্লোগান দেন। তবে তাদের ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আলাদা অনুষ্ঠানে তাদের স্লোগানের ভাষার তীব্র সমালোচনা করেন।

এরপর ক্যাম্পাসে সক্রিয় হয় ছাত্রলীগ। দুপুর ২টার দিকে তারা বিজয় ৭১ হলসহ বিভিন্ন হলে আন্দোলনকারীদের বাধা দেন। এ খবরে আন্দোলনকারীরা ছুটে গেলে ছাত্রলীগের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। উভয়পক্ষ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর থেকে গোটা ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

বিকেল ৪টার পর থেকে পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। এসময় ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠি-সোটা নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। বহু আন্দোলনকারীকে পিটিয়ে আহত করে তারা। তাদের অনেকের মাথা ফেটে যায়। আন্দোলনকারীরা কোথাও কোথাও প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ফলে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়।

বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে শতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হন। তাদের অধিকাংশই ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া আশপাশের অন্যান্য হাসপাতালেও গেছেন কেউ কেউ।

এরপর বিকেল ৫টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সামনে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফের সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। সেখানে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ উপস্থিত হয়ে ব্যারিকেড দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের থামিয়ে দেন যেন তারা সামনে যেতে না পারে। ঢাবির শহীদুল্লাহ হলের শিক্ষক ও প্রভোস্ট হলের শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন।

অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের হটাতে সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটের দিকে ঢাবির দোয়েল চত্বর এলাকা থেকে সাঁজোয়া যান নিয়ে অভিযান শুরু করে পুলিশ। রাত পৌনে ১০টার দিকে ক্যাম্পাস ছাড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও সোমবার বিকেল থেকে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেখানে অনেকে আহত হন। বিকেলে আন্দোলনে নামেন রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। তারা বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন।

রাতেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলার অভিযোগ ওঠে। রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একপর্যায়ে সেখানে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।

এ ছাড়া রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখশ হলে রড, স্ট্যাম্প ও লাঠিসোঁটা নিয়ে প্রবেশ করে বিভিন্ন রুমে তল্লাশি চালিয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

এনআই/এসএম