ঢাকার একটি কফি শপে ম্যানেজার পদে চাকরি করেন জহিরুল ইসলাম। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমার বয়স এখন ৫২ বছর। আগামী ৭-৮ বছর হয়তো আরও চাকরি করতে পারব। তারপর কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে।”

জহিরুল ইসলাম বলেন,“চাকরি জীবনে আয়ের বড় একটি অংশ গেছে ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচে। এছাড়া পরিবারের থাকা-খাওয়ার পেছনে ব্যয় আরেকটি অংশ। ফলে, খুব বেশি সঞ্চয় করতে পারিনি।"

প্রবীণ বয়সে ছেলে-মেয়ের মুখাপেক্ষী না থেকে স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে জহিরুল ইসলামের। সেখানে নিজের বয়সীদের সঙ্গে থাকার সুযোগ পাবেন বলে মনে করেন তিনি। এ ব্যাপারে তার ভাষ্য, "সন্তানের ওপর বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।”

প্রবীণ বয়সে নিজের সেবা-সুস্থতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই কর্মজীবী বলেন, “এখনি ছেলে-মেয়েরা নিজেদের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত। সামনে তাদের ছেলে-মেয়েরা বড় হবে। তাদের আলাদা বাসা লাগবে। তখন আমি আরও বেশি বৃদ্ধ হয়ে যাবো। তাদের সেই সংসারে আমার জায়গা নাও হতে পারে। আবার আবার সেই সামর্থ্য থাকবে না পৃথক বাসা নেওয়ার। কারণ বেসরকারি চাকরিতে তো কোনও পেনশনের ব্যবস্থা নেই।”

বেসরকারি ব্যাংকের একটি শাখার ম্যানেজার তানিয়া ইসলাম। তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, তার দুই ছেলে-মেয়ে। মেয়ে কানাডায় লেখা-পড়া করে। কয়েক বছর পরে ছেলে যাবে বিদেশে লেখা-পড়া করতে। তারা সেখানে স্থায়ী হয়ে যাবে বলে মনে করেন তানিয়া ইসলাম।

চাকরি থেকে অবসরে গেলে ঢাকায় থাকার ইচ্ছা তানিয়া ইসলামের। ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, “কারণ আমার সবকিছু এখানে। তখন মাঝে মধ্যে বিদেশে যাবো ছেলে-মেয়ের কাছে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে। কিন্তু সেখানে তো আর থাকবো না ।“

নিজের প্রবীণ বয়সের পরিকল্পনা জানতে চাইলে তানিয়া ইসলাম বলেন, “স্বামী আছেন। তার সঙ্গে থাকবো। আসলে তখন আর কোথায় যাওয়ার জায়গা থাকবে না। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে আমাদের যৌথ পরিবার ব্যবস্থা এখন আর নেই। যার কারণে চাইলেও এখন সবাই একসঙ্গে থাকতে পারে না।"

জহুরুল ইসলাম বা তানিয়া ইসলাম কোন ব্যতিক্রম নন। তাদের এই চিন্তা-ভাবনা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের চিন্তার প্রতিফলন।

২০৫০ সালে পৃথিবীর বৃহত্তম বয়স্ক জনসংখ্যার একটি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক-২০২৩ সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে এক কোটি ৬৪ লাখের বেশি মানুষের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি। শতকারা হিসেবে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৯.৭ শতাংশ প্রবীন জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। 

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) বলেছে, বাংলাদেশে ২০৫০ সালের মধ্যে, ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা হবে ৩.৬ কোটি এবং তা হবে মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। এটি বৈশ্বিক প্রবণতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটিতে পরিণত হয়েছে এবং এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় একজন বাংলাদেশি গড় আয়ু ছিল প্রায় ৪৭ বছর। এই সংখ্যাটি এখন ৭২-এর উপরে।

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি দশজন নাগরিকের একজনের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশকে পৃথিবীর বৃহত্তম বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার একটিতে পরিণত করবে।

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য কী ব্যবস্থা রয়েছে দেশে

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম হলো বয়স্কভাতা কর্মসূচি।

বাংলাদেশে সরকারের সমাজ সেবা অধিদপ্তরের তথ্য বলছে- ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮ লক্ষ ১ হাজার বয়স্ক ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়।

২০১৩ সালে প্রবীণদের জন্য ‘পিতামাতার ভরণ-পোষণ’ নামে একটা নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো পর্যবেক্ষণ ও কার্যকর করার জন্য প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন ২০১৭ চূড়ান্ত করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে প্রবীণদের নিয়ে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক এ এস এম আতীকুর রহমান। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকলেও ভবিষ্যতে এই জনগোষ্ঠীর সেবা ও চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং জনবল এখনও অপ্রতুল।

আতীকুর রহমান আশংকা প্রকাশ করেন যে, "২০৫০ সালে আমাদের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।”

তিনি বলেন, "আমি ৮০'র দশক থেকে বার্ধক্যের সঙ্গে জড়িত। আমাদের এখানে কেউ বার্ধক্যে আসতে চায় না, বার্ধক্য বুঝতে চায় না, বার্ধক্য নিয়ে সচেতনও নয়।”

আতীকুর রহমান বলেন, “শুধু মাত্র আমাদের বার্ধক্য নিয়ে রাজনৈতিক কিছু ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। হয়তো প্রবীণদের ভোট আছে সেই কারণে। যে কারণে রাজনৈতিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে ১৯৯০ সালের পরে প্রবীণদের কল্যাণে কিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।”

সর্বজনীন পেনশনও প্রবীণদের কল্যাণের কথা চিন্তা করে করা হয়েছে, বলে মনে করনে আতীকুর রহমান।

তিনি বলেন, “সর্বজনীন পেশনের...জন্য ৩০ বছর প্রিমিয়াম দিতে থাকবো। এটার সুবিধা আমরা ২০৫০ সালের পরে গিয়ে পাবো।”

চালুর অপেক্ষা সরকারি ৮টি প্রবীণ নিবাস

আতীকুর রাহমান বলেন, বাংলাদেশে প্রবীণদের একটা চাহিদা হলো আবাসন। তবে, 'বৃদ্ধাশ্রম' বা 'প্রবীণ-নিবাসের' ক্ষেত্রে একটি ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করেন এই শিক্ষক, “আমাদের এখানে মুসলিম সংস্কৃতিতে বৃদ্ধাশ্রম বলে কোনও বিষয় নেই।"

তিনি আরও বলেন, “আমরা সনাতম ধর্মের পাশে থাকি বলে বৃদ্ধাশ্রমের বিষয়টি আসছে। সনাতম ধর্মে প্রবীণ কল্যাণের একটা ব্যবস্থা আছে, যেটা বাংলাদেশে মুসলিমরা গ্রহণ করে নাই। যে কারণে বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম নেই বললেই চলে।”

বাংলাদেশে বৃদ্ধাশ্রম কিংবা প্রবীণ নিবাস নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন এই ব্যাংকার তানিয়া ইসলাম। তার মতে, “এখানে প্রবীণ নিবাসে থাকাকে সামাজিকভাবে অসম্মানের চোখে দেখা হয়। আবার দেশে মানসম্পন্ন প্রবীণ নিবাসও নেই। তাই আমাদের দেশে 'বাধ্য হয়ে' প্রবীণদের সেখানে থাকতে হয়। ভবিষ্যতে মানসম্পন্ন প্রবীণ নিবাস হলে মানুষ সেখানে নিজ সমবয়সীদের সঙ্গে থাকার চিন্তা করতে পারবে।”

সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মো. সাব্বির ইমাম ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, “সরকারের উদ্যোগে দেশের ৮ বিভাগে ৮ টি প্রবীণ-প্রবীণা নিবাস করা হয়েছে। প্রতিটি নিবাসে ২৫ জন প্রবীণ ব্যক্তির থাকার উপযুক্ত করে করা হয়েছে।”

তবে তিনি জানান, এ নিবাসগুলো এখনও চালু হয়নি। অর্থমন্ত্রণালয়ে নিবাস পরিচালনার বাজেট দেওয়া হয়েছে। অর্থ অনুমোদন হলে, পরের ধাপ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ। এরপর তা চালু করা সম্ভব হবে।

বেসরকারিভাবে দেশে কতটি প্রবীণ নিবাস বা বৃদ্ধশ্রম রয়েছে তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণলায় কিংবা অধিদপ্তর কারও কাছে এই সংক্রান্ত কোনও তথ্য নেই। তবে, বাংলাদেশের সাভার-গাজীপুর এলাকায় কয়েকটি বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে বলেও জানা গেছে।

শিক্ষক আতীকুর রহমান বলেন, "বাংলাদেশে যেসব প্রবীণ নিবাস আছে, সেখানে হয়তো ২ হাজার লোকের ব্যবস্থা আছে।"

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কাঠামো প্রবীণদের জন্য যথেষ্ট নয়

জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের সাথে দেশের স্বাস্থ্যসেবার উপর চাপ বাড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে প্রবীণ জনগোষ্ঠী যে ধরণের অসংক্রামক রোগের শিকার হন সেগুলোর চিকিৎসা সেবার উপর।

তবে প্রবীণদের জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবী করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল।

আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনা করে আবু জামিল ফয়সাল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “সরকারের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটাই কাজ, কিভাবে বিল্ডিং তৈরি করবে, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয় করবে, বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ দেবে। কিন্তু তারা কখনও পরিকল্পনা গ্রহণ করে না যে, এই যে আগামীতে ২২ শতাংশ লোক প্রবীণ হবে বা এখন যারা প্রবীণ রয়েছে তাদেরকে স্বাস্থ্য সেবা দিতে কি দরকার।"

আবু জামিল বলেন, "তাদের ব্লাড প্রেসার, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক ও কিডনি জটিলতা দেখা দেবে। এখন থেকে যদি আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ না করি, তাহলে তো সবকিছু ভেঙে পড়বে। আর প্রস্তুতি কিভাবে নিবেন? এখনকার জনগোষ্ঠীকে ঠিক মতো স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারেন না। ২০৫০ তো অনেক দূরে। আসলে সরকার কি করে কিছু বুঝি না।”

বিশ্ব ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের নাগরিকদের নিয়মিতভাবেই ব্যয়বহুল স্বাস্থ্যব্যবস্থা, ওষুধসেবার অপর্যাপ্ততা, এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থসেবাদানকারীর অভাবের মত বিষয়গুলোর সম্মুখীন হতে হয়। প্রবীণদের জন্য এই সমস্যাগুলো আরও গুরুতর হয়ে উঠে।

“প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনও কর্মসূচি নেই”- বলেও দাবি করেন শিক্ষক আতীকুর রহমান।

সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা

এসএমডব্লিউ