গত ১৫ বছরে প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে অনেকটা ‘বিতর্কমুক্ত’ নিয়োগ দিয়ে প্রার্থীদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এরপর বিভিন্ন সরকার ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়া করতে এ সংস্থাটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আবার নন ক্যাডার থেকে প্রচুর প্রার্থী দ্বিতীয় শ্রেণিতে চাকরি পেয়েছেন। এরমধ্যে রেলওয়ের একটি নিয়োগ পরীক্ষা প্রশ্নফাঁস হওয়ার খবর গণমাধ্যমে আসার পর সারা দেশে হইচই শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, পিএসসি নিয়োগ কি আদৌ নিরপেক্ষ হয়েছে। এ ঘটনার পর আস্থায় সংকটে পড়েছে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি।

গণমাধ্যমে আসার তথ্য ও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছড়িয়ে পড়া তথ্যে সঠিক নয় দাবি করে সংস্থাটির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন বলছেন, একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা পুরো সংস্থার প্রতি আস্থার সংকটে পড়েছে তা আমি মানতে নারাজ। 

তিনি বলেন, গত ১৫ বছরের চাকরি প্রার্থী বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরি প্রার্থীদের আস্থার জায়গা হয়ে উঠেছে পিএসসি। নিয়োগ প্রক্রিয়া যদি কোনো গ্যাপ থাকতো তা অবশ্যই ধরা পড়তো। তিনি মনে করেন, পুরো ঘটনাটি তদন্ত চলছে। এরপর বলতে পারবো আসলে কী হয়েছে।

আতঙ্কে চাকরি পাওয়া কর্মকর্তারা

গত ১৫ বছরে চাকরি নানা সেক্টরে প্রশ্নফাঁস হলেও পিএসসি থেকে প্রশ্নফাঁস হওয়ার খবর এতদিন তেমন বের হয়নি। প্রশ্নফাঁসের খবর প্রকাশের পর এবার কাঠগড়ায় প্রতিষ্ঠানটি। এক যুগে বিসিএসসহ অন্তত ৩০টি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে অভিযুক্তরা ইতোমধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এসব পরীক্ষা ও সেখানে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের বিষয়ে কি করবেন তা বুঝতে পারছেন না পিএসসি চেয়ারম্যান।

পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার সত্যতা মিললে যারা চাকরি পেয়েছেন, তাদের চাকরি বাতিল করা হবে কি না এমন প্রশ্নের পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন বলেছেন, এটি খুব কঠিন প্রশ্ন। আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা না বলে, বিধিমালা না দেখে, সামগ্রিকভাবে বিবেচনা না করে এটি নিয়ে সম্ভব না কিছু বলা।

এদিকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন বিসিএসের ব্যাচ থেকে ক্যাডার (প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা) হওয়া অনেকের নাম বেরিয়ে আসছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অভিযানে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের গ্রেপ্তার সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব নাম পাওয়া যাচ্ছে। আপাতত ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার হওয়াদের নামের তালিকা তৈরি ও জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে।

যদিও ফাঁস হওয়া প্রশ্নে কে কে উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের চিহ্নিত করা কঠিন কাজ মনে করছে পিএসসির একজন সদস্য। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রমাণ পাওয়ার পর চাকরি থেকে তাকে বের করার জটিল প্রক্রিয়া। প্রশ্নফাঁসে এবার প্রথম কোনো মামলা হয়েছে। তাই পিএসসির এ ধরনের অভিজ্ঞতা নেই। এছাড়া পিএসির অধীনে কোনো পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে চাকরি পেয়ে পরে বরখাস্ত হয়েছেন এমন কোনো উদাহরণ পায়নি। এটা আইনি বিষয়।

তদন্ত শুরু করেছে কমিটি, সন্দেহের বাইরে নেই কেউ

বিসিএসের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পিএসসি। ৯ জুলাই (মঙ্গলবার) করা কমিটিকে ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়েছে। কমিশনের যুগ্ম সচিব ড. আব্দুল আলীম খানের নেতৃত্বে বাকি সদস্যরা বুধবার থেকে কাজ শুরু করেছে।

কমিটির আহ্বায়ক ড. আব্দুল আলীম খান বলেন, তদন্ত কমিটি গঠনের পরই অন্য আমরা বসে তদন্তে কীভাবে করবো তা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করেছি এবং কাজ শুরু করেছি। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দিতে পারবো।

তিনি জানান, প্রশ্নফাঁসের তদন্ত করা খুবই জটিল একটি কাজ। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলবো। তবে সন্দেহের বাইরে কেউ নন। যাকে আমরা মনে করবো তাকেই তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

তদন্তে দুদকের সহায়তা চায় পিএসসি

প্রশ্নফাঁসের অধিকতর তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে চিঠি দিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশন। সংস্থাটি মনে করছে, যেহেতু দুদক একটি নিরপেক্ষ সংস্থা, এ ধরনের ব্যক্তিদের অবৈধ সম্পদের তদন্ত প্রতিষ্ঠানটি করে থাকে; তাই তাদের সহায়তা প্রয়োজন। এজন্য বুধবার পিএসসি থেকে দুদকের সচিব বরাবর তদন্ত চেয়ে চিঠি পাঠিয়ে পিএসসি।

চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এস এম মতিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য এসেছে তাই এগুলো অধিকতর তদন্ত ও তথ্য সংগ্রহের জন্য দুদকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পিএসসি এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। তাদের বিষয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি নাম গোপন করে তথ্য দিতে চায় তারাও পিএসসিতে জানাতে পারবে।

এনএম/এসএম