• মাংস বিক্রির জন্য ১৫টি ব্রাহমা জাতের গরু জবাই করার কথা
• সেই গরুগুলোর মধ্যে ৬টি জব্দ হয় সাদিক অ্যাগ্রো থেকে
• পাওয়া যায় সাতটি ব্রাহমা বাছুর ও সিমেন বিক্রির তালিকা
• বেআইনিভাবে কৃত্রিম প্রজননের প্রমাণ পেয়েছে দুদক

দেশব্যাপী আলোড়ন তোলা সেই সাদিক অ্যাগ্রোর নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু আমদানি, বেআইনিভাবে প্রজনন, লালন-পালন এবং গরুগুলোর সিমেন (বীর্য) বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির তথ্য পাওয়া গেছে।

বেশি দামে সিমেন ও শত শত বাছুর বিক্রি করে দেশব্যাপী নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু ছড়িয়ে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। অথচ ২০২১ সালে জব্দ হওয়ার পর ব্রাহমা জাতের গরুগুলো কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের তত্ত্বাবধানের রাখা হয়েছিল। এ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও সেখান থেকে কীভাবে এসব গরুর কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো এবং প্রজনন কেন্দ্র থেকে সিমেন সাদিক অ্যাগ্রোতে গেল— সেটাই এখন বড় প্রশ্ন?

কারণ, বেসরকারি পর্যায়ে সরকারি অনুমোদন ছাড়া কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম নিষিদ্ধ। জানা যায়, ২০১৩ সালে বিফ-ক্যাটল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এ প্রকল্পের গাইডলাইনে বলা হয়, কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে। ফলে এ ক্ষেত্রে বেসরকারি পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনার আপাতত কোনো সুযোগ নেই। দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্ধারিত গাভি পালন এলাকায় মাংস বৃদ্ধির জন্য পশু পালন থেকে বিরত থাকতে হবে।

অন্যদিকে, যার মাধ্যমে ব্রাহমা জাতের গরু অবৈধভাবে দেশে আমদানি করা হয়, সেই সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনকে নিলামে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়ে কৌশলে মাংস বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারা এই অনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদেরও খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বেশি দামে সিমেন ও শত শত বাছুর বিক্রি করে দেশব্যাপী নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের গরু ছড়িয়ে দেওয়ার মহাপরিকল্পনা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। অথচ ২০২১ সালে জব্দ হওয়ার পর ব্রাহমা জাতের গরুগুলো কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের তত্ত্বাবধানের রাখা হয়েছিল। এ অবস্থায় নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও সেখান থেকে কীভাবে এসব গরুর কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো এবং প্রজনন কেন্দ্র থেকে সিমেন সাদিক অ্যাগ্রোতে গেল— সেটাই এখন বড় প্রশ্ন?
সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন। নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের ১৫টি গরুসহ ৪৮৮টি গরু জবাই এবং এর মাংস বিক্রিতে অভিনব প্রতারণার আশ্রয় নেন / ছবি- সংগৃহীত

বুধবার (৩ জুলাই) দুদকের সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে একটি দল দ্বিতীয় দফায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সাদিক অ্যাগ্রোর ভিন্ন এক খামারে অভিযান চালায়। সেখান থেকে ছয়টি ব্রাহমা জাতের গরু জব্দ করা হয়। পরে গরুগুলো দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠানকে। ওই সময় ঢাকা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বাসনা আক্তারও উপস্থিত ছিলেন।

জব্দের বিষয়ে দুদক কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকারি কাগজে-কলমে উদ্ধার করা গরুগুলো জবাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে সেগুলো জীবিত পেয়েছি। গরুগুলো প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীন গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে হস্তান্তর করা হয়েছে।

‘গরুগুলোর মাংস বিক্রির শর্তে ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল’— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আপাতত মনে হচ্ছে, এখানে জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি নিয়ে কমিশন বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। এরপর কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালিত হবে।’

এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৫টি ব্রাহমা জাতের গরুসহ ৪৪৮টি গবাদিপশু জবাই করে ৬০০ টাকা কেজি দরে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রি করতে ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনকে নিলামের মাধ্যমে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং প্রতারণার মাধ্যমে ব্রাহমা জাতের গরুগুলো তার খামারে নিয়ে আসা হয়। যা ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি।

 

গত সোমবার বিকেলে সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে অভিযান চালায় দুদক / ছবি- সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, গত তিন বছর ধরে ব্রাহমা জাতের গরুগুলো কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে ছিল। এ অবস্থায় সেখান থেকে কীভাবে গরুগুলোর সিমেন (বীর্য) সাদিক অ্যাগ্রোতে হস্তান্তর করা হলো, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও গরুগুলোর কৃত্রিম প্রজনন ঘটানো হলো এবং সিমেন ও বাছুর বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হলো— বিষয়গুলো তদন্ত করে বের করা হবে। কারণ, দুদকের অনুসন্ধানে সিমেন বিক্রির তালিকা পাওয়া গেছে, যা জব্দ তালিকার মধ্যে রয়েছে। একটি মাফিয়া সিন্ডিকেট পর্দার আড়ালে এখানে কাজ করেছে। অবশ্যই জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, চলতি বছরের রমজান মাসে সরকারি সিদ্ধান্তে ব্রাহমা জাতের ১৫টি গরুসহ ৪৪৮টি পশু জবাই করে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে বিক্রির কথা ছিল। বুধবার সেই ব্রাহমা জাতের ১৫টি গরুর মধ্যে ছয়টি গরু সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে উদ্ধার করা হয়। অথচ সরকারি খাতায় গরুগুলো জবাই করা হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।

জানা যায়, ২০২১ সালে নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের ১৮টি গরু আমদানি করে সাদিক অ্যাগ্রো। কাস্টমস বিভাগ বিমানবন্দরে গরুগুলো জব্দ করে। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গরুগুলো প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের হস্তান্তর করা হয়। সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন সুকৌশলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গরুগুলো নিজ খামারে নিয়ে আসে।

যার মাধ্যমে ব্রাহমা জাতের গরু অবৈধভাবে দেশে আমদানি করা হয়, সেই সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনকে নিলামে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়ে কৌশলে মাংস বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারা এই অনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদেরও খুঁজছে দুর্নীতি দমন কমিশন
সাভারের সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে আমদানি নিষিদ্ধ ব্রাহমা জাতের সাতটি বাছুর জব্দ করা হয় / ছবি- সংগৃহীত

এর আগে সোমবার মোহাম্মদপুরে সাদিক অ্যাগ্রোর আরেকটি খামারে অভিযান চালায় দুদক। সেখান থেকে সাত থেকে ১০ মাস বয়সী সাতটি ব্রাহমা জাতের বাছুর জব্দ করা হয়। অভিযানে খামারে কৃত্রিম প্রজনন সংক্রান্ত হিসাব ও কসাই খাতা উদ্ধার করা হয়। এতে দেখা যায়, গত মাসে পাঁচটি ব্রাহমা জাতের গাভীকে স্পার্ম (শুক্রাণু/পুংজননকোষ) দেওয়া হয়েছে। যদিও ওই দিন খামারে পাঁচটি ব্রাহমা জাতের গাভীর দেখা মেলেনি।

দুদক কর্মকর্তারা জানান, শাহিওয়াল জাতের নাম দিয়ে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮টি ব্রাহমা জাতের গরু জাল কাগজপত্র তৈরি করে দেশে আনেন সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেন। ২০১৬ সালে সরকার ব্রাহমা জাতের গরু বাংলাদেশে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

আমদানিনিষিদ্ধ উন্নত জাতের গরুগুলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জব্দ করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। একটি গরু ওই সময় মারা যায়। অন্য গরুগুলো পাঠানো হয় সাভারের গো-প্রজনন কেন্দ্রে। সেখানে আরও দুটি মারা যায়। গরু আমদানি নিয়ে ওই বছরই হাইকোর্টে শুনানি হয়। আদালত তখন গরুগুলো জব্দ করার সিদ্ধান্তের পক্ষে রায় দেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাদিক অ্যাগ্রোর মালিক ইমরান হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি / ছবি- সংগৃহীত

২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গরুগুলো সাভারের গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারেই লালন-পালন করা হয়। পরে গরুর মাংসের চাহিদা মেটাতে ওই গরুসহ জব্দ করা অন্যান্য গরু জবাই করে এর মাংস ন্যায্যমূল্যে সাধারণের মধ্যে সরবরাহের উদ্দেশ্যে নিলামে তোলা হয়। দায়িত্ব পায় ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশন।

গত ৫ মার্চ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক ড. এবিএম খালেদুজ্জামানের স্বাক্ষরিত এক পত্র সূত্রে জানা যায়, খামারে পালিত প্রজনন অনুপযোগী কিন্তু মাংস খাওয়ার উপযোগী ৪৪৮টি (১৫টি ব্রাহমা জাতের গরুসহ) গবাদিপশু বাছাই কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত বুকভ্যালু এবং ভ্যাট ও উৎস কর পরিশোধ সাপেক্ষে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রয়ের অনুমোদন প্রদান করা হলো।

আলোচিত ছাগল-কাণ্ডে এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ছাগলটি সাদিক অ্যাগ্রো থেকে কিনে এক লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেন। পরবর্তীতে এ নিয়ে যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে ছাগলটি আর ওই খামার থেকে নেননি ইফাত। ওই ঘটনার পর সাদিক অ্যাগ্রোকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। পরে অবৈধভাবে খাল ও সিটি কর্পোরেশনের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা সাদিক অ্যাগ্রোর খামার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

আরএম/এমএআর/এমজে